নারায়নগঞ্জ

রূপগঞ্জের তারিকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই

তোহুর আহমদ

‘নারায়ণগঞ্জ, ০৭ জানুয়ারি- মাত্র ৫ বছর আগেও এলাকায় সাদামাটা চলাফেরা ছিল তার। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ফুটফরমাশ খাটতেন। কিন্তু এখন তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক। চড়েন চার কোটি টাকা মূল্যের সর্বাধুনিক দামি গাড়িতে। ঘুরে বেড়ান একাধিক অস্ত্রধারী প্রহরী নিয়ে। আভিজাত্যে ভরপুর নিজস্ব বাগানবাড়ি থেকে শুরু করে রংমহল-কি নেই তার! রূপগঞ্জের কেন্দুয়া এলাকার আলোচিত এ ব্যক্তির নাম তারিকুল ইসলাম। তবে তিনি মোগল নামে এলাকায় সর্বাধিক পরিচিত।

এ প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, জমি জবরদখল, অনলাইন জুয়া এবং ক্যাসিনোর বদৌলতে অঢেল ধনসম্পদ, প্রাচুর্য তার কাছে যেন স্বেচ্ছায় ধরা দেয়। অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়ার মতোই তিনি রাতারাতি ধনকুবের বনে যান। অথচ মোগলের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। রূপগঞ্জ থানায় হত্যা মামলাসহ একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জবরদখল, হুমকি, চাঁদাবাজির অভিযোগ ভূরি ভূরি। তার ফাঁসির দাবিতে এলাকায় মিছিল-মিটিংও হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মোগলের দাপট কমেনি।

মোগলের আলোচিত প্রাসাদ : সম্প্রতি কেন্দুয়ার অজপাড়াগায়ে মোগলের প্রাসাদতুল্য চোখ ধাঁধানো বাড়ি পথচারীদের নজর কেড়েছে। বাইরে নামফলকে লেখা ‘তাওহিদ নূর প্রাসাদ’। হোল্ডিং নম্বর ০১৭৬০০। আলোচিত এই বাড়িটি মোগলের বিপুল বিত্তবৈভবের অন্যতম সাইনবোর্ড। দুর্ভেদ্য নিরাপত্তায় ঘেরা সুরম্য বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই থমকে দাঁড়ান। অন্তত ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটি গড়ে উঠেছে বিশাল জায়গার উপর। বাড়ির ৩টি ফ্লোরের আয়তন ১৪ হাজার স্কয়ার ফুটেরও বেশি। সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত বাড়ির নিরাপত্তায় রয়েছে সার্বক্ষণিক অস্ত্রধারী প্রহরী।

বাড়ির অন্দরমহল ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, অত্যাধুনিক স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া রয়েছে বাড়িটির সর্বত্র। আছে পাঁচতারকা হোটেলের সব সুযোগ-সুবিধা। ভেতরে বিশাল সুইমিংপুল। খেলার মাঠ, বাগান, ল্যাম্পপোস্ট এবং ওয়াকওয়ে। একালের রাজপ্রাসাদ বললেও ভুল বলা হবে না।

প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই বিশাল লন, ল্যান্ডস্কেপসহ বাগান পার হলে দেখা যাবে আরেকটি লন। এরপর কারুকার্যখচিত বিশাল দরজা। বাম পাশে চোখ ধাঁধানো সাজসজ্জায় ঠাসা ড্রইংরুম। সঙ্গে রাজকীয় ঝাড়বাতি। পাশ দিয়ে মার্বেল পাথরে বাঁধানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির নিচে দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা। সেখানে সাঁতরে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছ। বাড়ির প্রতিটি কক্ষে বিশালাকার টিভি পর্দাসহ অত্যাধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। টিভির সংখ্যা এক ডজন। প্রতিটির দাম কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা।

আরো পড়ুন: শীতলক্ষ্যা সেতু প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ হচ্ছে না

বুলেটপ্রুফ গ্লাস দিয়ে সাটানো বাড়িটি কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। দোতলার পাশ দিয়ে আরেকটি সিঁড়ি উঠে গেছে তৃতীয় তলায়। পাশেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় সেন্সরযুক্ত লিফট। তৃতীয় তলায় কৃত্রিম ঘাস লাগিয়ে টানা বারান্দা করা হয়েছে। এর পাশে মিউজিক রুম।

বৃষ্টিবিলাসের জন্য ছাদে রয়েছে বিদেশি কাচ দিয়ে বসার ব্যবস্থা। সেখানে বসলে মনে হবে বৃষ্টি পড়ছে সরাসরি মাথার উপর। বাড়িতে আছে জ্যাকুজি, সুনাবাথ এবং জিমন্যাসিয়াম। তিনি বলেন, নির্মাণশৈলীর কারণে বাইরে থেকে বাড়িটি ডুপ্লেক্স মনে হলেও আসলে এটি ট্রিপ্লেক্স। কড়া নিরাপত্তার কারণে বাড়ির সামনে অপরিচিত কারও দাঁড়ানো একেবারেই নিষিদ্ধ। পরিবারের সদস্যরা বাড়ির বাইরে পা দিলেই ছায়াসঙ্গী হয় মহারাজ নামের এক সশস্ত্র প্রহরী।

যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে শ্রীলংকা, দুবাই, নেপাল ও মালয়েশিয়ার বড় বড় ক্যাসিনোতে মোগলের রয়েছে বিশেষ সমাদর। তার নামে বিমানের বিজনেস ক্লাসের টিকিট এবং পাঁচতারকা হোটেলে বিশেষ সুইট বরাদ্দ থাকে সব সময়। বিদেশের ক্যাসিনোতে মোগলের অন্যতম সঙ্গী মিরপুর এলাকার কুখ্যাত জুয়াড়ি মনির ওরফে আমেরিকান মনির ও সোহেল খান।

মোগল ও আমেরিকান মনিরের নামে শ্রীলংকার বেলিস ক্যাসিনো থেকে ইস্যু করা ইউএল এয়ারলাইন্সের টিকিটের কপি সম্প্রতি যুগান্তরের হাতে আসে। এতে দেখা যায়, ব্যালিস ক্যাসিনোর এজেন্ট নালিন মাঞ্জুলা ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ মোগল ও মনিরের নামে মোট ৪টি বিজনেস ক্লাসের টিকিট পাঠান। টিকিটে তাদের দুজনের ক্যাসিনো মেম্বারশিপ নম্বর বিএম ৫৭৩৬৬ (তারিকুল ইসলাম মোগল) এবং বিএম ৫২৬৫৫ (মনির উদ্দিন) উল্লেখ করা হয়।

সূত্র বলছে, মাঝেমধ্যে বিদেশে যেতে না পারলে দেশে বসেই বিশেষ ব্যবস্থায় ভার্চুয়ালি ক্যাসিনো খেলেন শ্রীলংকা ও মালয়েশিয়ার ক্যাসিনো কোর্টে। অনেক সময় তার দুই সহযোগী সোহেল খান ও আমেরিকান মনির বিদেশের ক্যাসিনো টেবিল থেকে ভিডিওকল দেন। মোগল নিজের বাগানবাড়ি থেকেই অংশ নেন।

এছাড়া তিনি নিয়মিত নেপাল ও মালয়েশিয়ার ক্যাসিনোতে খেলতে যান। প্রতিবার বিদেশে যাওয়ার আগে কমপক্ষে ১৫/২০ কোটি টাকা হুন্ডি করা হয়। কামরুল নামের বিশ্বস্ত এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে টাকা বিদেশে নেওয়া হয়। মোগলের ক্যাসিনো খেলার কথা স্থানীয় প্রশাসনের অজানা নয়। রাজনৈতিক প্রভাবশালী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই মোগলের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা নেন।

ইমিগ্রেশন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোগল নিয়মিত শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, দুবাই ও থাইল্যান্ডে যাতায়াত করেন। ৩ বছরে শুধু মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা ও দুবাই যান ৫০ বারেরও বেশি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে কুয়ালালামপুর যান পাঁচবার, কলম্বো ছয়বার ও একবার ব্যাংকক।

২০১৮ সালে কলম্বো গেছেন ছয়বার, কুয়ালালামপুর চারবার ও একবার যান জেদ্দা। ২০১৯ সালেও তিনি দফায় দফায় শ্রীলংকা যান। ঢাকা-কলম্বো যাতায়াত করেন ১২ দফা, দুবার গেছেন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে, একবার ব্যাংক ও একবার দুবাই ভ্রমণ করেছেন।

মোগলের বিদেশ যাতায়াত সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে এক পুলিশ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, মোগলের বিদেশে যাতায়াত করাটা অনেকটা ডালভাতের মতো। কারণ ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি তিনি কলম্বো গিয়ে ফিরেছেন ছয়দিন পরই। আবার ১৯ জানুয়ারি গিয়ে ফিরেছেন ১০ দিন পর (২৮ জানুয়ারি)। মার্চ ও এপ্রিলেও পরপর কয়েক দফা তিনি কলম্বো গেছেন। ৬ মার্চ কলম্বো গিয়ে ফেরেন ১১ মার্চ। আবার ১৫ মার্চ গিয়ে ফেরেন ১৯ মার্চ। ১১ এপ্রিল গিয়ে ফিরে আসেন ১৭ এপ্রিল।

সূত্র বলছে, মোগল সবচেয়ে বেশি যান শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোর বেলিস ক্যাসিনোতে। মাঝেমধ্যে তাকে দেখা যায় মালয়েশিয়ার গ্যাংটিং হাই ল্যান্ড ক্যাসিনোয়। তবে সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে ক্যাসিনোতে তিনি ব্ল্যাক লিস্টেড। মোগল দুবাইয়ে বিমানবন্দরে ই-গেট দিয়ে প্রবেশ করেন বিনা বাধায়। কারণ তিনি দুবাইয়ের স্থায়ী রেসিডেন্ট কার্ডহোল্ডার। বিপুল অঙ্কের টাকায় বিনিয়োগকারী ক্যাটাগরিতে দুবাইয়ের রেসিডেন্ট কার্ড নিয়েছেন তিনি। তার দুবাই রেসিডেন্ট আইডি নম্বর ৫৭২৩৬৪৬০।

কোটি টাকা মূল্যের একাধিক গাড়ি ব্যবহার করেন মোগলের পরিবারের সদস্যরা। তিনি নিজেও দুটি বিলাসবহুল পাজেরো ব্যবহার করেন। এর মধ্যে একটি মিটসুবিসি পাজেরো (নম্বর ঢাকা মেট্রো ১৮-৫২০৮) এবং অপরটি ৪ কোটি টাকা মূল্যের ভি৮ সাহারা ল্যান্ডক্রুজার (নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৭৫৫০)। প্রথম গাড়িটি তার নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করা হলেও অপরটি ভিন্ন নামে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা সাহারা ল্যান্ডক্রুজার গাড়িটি প্রয়াত এক নারী সংসদ সদস্যের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেন্দুয়া এলাকায় মোগলের বিশাল বাহিনী রয়েছে। কয়েকজন বেতনভুক্ত অস্ত্রধারী তাকে সার্বক্ষণিক পাহারা দেয়। মাঝেমধ্যে তাদের পাঠানো হয় জমি দখলের কাজে। মোগলের ক্যাডারদের মধ্যে মহিন মোল্লা, আতিকুর, নাজমুল, শাহরিয়ার, আলী বান্দা, শাহিন ওরফে লোহা শাহিন, শাহদাৎ, খান সোহেল, মতিন ও শাহ আলম অন্যতম।

এছাড়া ভুয়া দলিল তৈরিতে সিদ্ধহস্ত লোকজনের বিশেষ টিম রয়েছে তার। জমির ভুয়া ওয়ারিশ সাজিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বানানো হয়। এরপর রেজিস্ট্রি অফিসের সহযোগিতায় দলিল রেজিস্ট্রির পর অস্ত্রের মুখে উচ্ছেদ করা হয় মালিকদের। এ সময় এলাকায় ত্রাস ছড়াতে অগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে যখনতখন গুলি ছোড়েন মোগলের লোকজন।

সূত্র বলছে, এ প্রক্রিয়ায় কেন্দুয়া, হল্লারটেক, জাল্লাপাড়া, তারোইল, কড়াটিয়া, আঙ্গারজোড়া, বিরোবো ও কাঞ্চন এলাকায় শত শত বিঘা জমি দখল করা হয়েছে। বিশেষ করে কেন্দুয়া ও হাল্লারটেক এলাকায় অসংখ্য মানুষকে অস্ত্রের মুখে বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়। অনেকের চাষযোগ্য বিস্তীর্ণ ফসলি জমি রাতারাতি বালু ভরাটের ফলে বেদখল হয়ে গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কেন্দুয়া এলাকার চাঁন টেক্সটাইলের বিপরীতে অন্তত ৩০ বিঘা জায়গা জবরদখল করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দখল করা জমিতে মোগলের নামে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এছাড়া কেন্দুয়ার মোস্তাপুর এলাকায় দখল করা জমিতে তিনি নির্মাণ করেছেন বিশাল বাগানবাড়ি। শখের বাগান বাড়িতে আছে ৬টি হরিণ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাংলো, দেশি-বিদেশি ফলের বাগান, পুকুর ও অফিস। বাংলো পাহারায় সার্বক্ষণিক ৪/৫ জন কর্মচারীও রয়েছেন।

বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার শাহ আলম বলেন, ‘২/১ দিন পরপরই স্যার এখানে আসেন। হরিণগুলো তার খুব প্রিয়। মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধব নিয়ে স্যার এখানে পার্টি করেন। বাগানবাড়ির টাটকা শাকসবজি প্রতিদিন স্যারের ঢাকার বাসায় পাঠানো হয়।’

ক্যাসিনো খেলা ও জমি দখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে চাইলে তারিকুল ইসলাম মোগল বুধবার রাত ৯টায় এ প্রতিবেদককে বলেন, অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ‘ক্যাসিনো কী জিনিস জীবনে আমি দেখিনি। আমি মূলত একজন ডেভেলপার ব্যবসায়ী। তবে সম্প্রতি আমার ব্যাবসা অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিয়েছি। এখন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডেভেলপার পার্টনার হিসেবে আছি।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জমি দখলের অভিযোগ কেউ করতে পারে। তবে সত্যতা পাবেন না। কারণ আমি কোনো ধরনের জমি দখল বাণিজ্যের সঙ্গে আগেও জড়িত ছিলাম না এখনো নেই।’

সূত্র: যুগান্তর

আর/০৮:১৪/৭ জানুয়ারি

Back to top button