অপরাধ

সারা দেশে আইপিএল জুয়ায় নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই, নেই কোনো নজরদারি

এস এম আজাদ

ঢাকা, ২৯ অক্টোবর- হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের এক জুয়েলারি ব্যবসায়ী যাঁর নিজের দুটি দোকানভিটাও ছিল, তিনি এখন নিঃস্ব। এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন শ্বশুরবাড়ি। তাঁর জীবনে এমন ছন্দঃপতন কেন ঘটল? উত্তর পেতে দেরি হলো না। ক্রিকেট খেলা নিয়ে বাজি ধরার নামে জুয়ায় মেতে তাঁর সর্বনাশ হয়েছে। উপজেলার বড়বাজারের ওই ব্যবসায়ী প্রতিবছর ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল আসর চলার সময় সেখানকার করিম উল্লাহ গলি, জিপস্ট্যান্ড, কামালখানী রোড, আদর্শ স্কুল রোডসহ কয়েকটি স্থানে বসা জুয়ার আসরের নিয়মিত মুখ ছিলেন। একসময় ব্যবসায় টান পড়ে। তবু ঋণ করে জুয়া খেলেন। শেষ পর্যন্ত দোকানভিটা বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে হয় তাঁকে।

চার বছর আগেও শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের নূর ইসলাম (৩০) আইপিএল জুয়ায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। একপর্যায়ে নিজের ৪০ লাখ টাকা দামের ট্রাক বিক্রি করে দিয়েছিলেন ২৫ লাখ টাকায়। জুয়ায় হারতে হারতে সর্বস্বান্ত নূর ইসলাম এখন অন্যের ট্রাকের চালক।

ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের গায়ে জুয়ার কলঙ্ক লেগেছে অনেক আগেই। ম্যাচ গড়াপেটা বা স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে ক্যারিয়ার বরবাদ হয়েছে অনেক খেলোয়াড়ের। জুয়া শুধু খেলোয়াড় বা কর্মকর্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তাতে জড়িয়েছে দর্শকরাও। টেলিভিশনে খেলা দেখে বাজি ধরায় গা ভাসাচ্ছে বাংলাদেশের দর্শকরাও। আর এ জুয়া এখন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সবখানে। সবচেয়ে বেশি জুয়া হয় লম্বা সময় ধরে এবং বিশ্বের ক্রিকেট তারকাদের অংশগ্রহণে হওয়া আইপিএল ঘিরে। পেশাদার জুয়াড়িরাও এর সুযোগ নিচ্ছেন। নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে।

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মাঠে দর্শকের উন্মাদনা না থাকলেও আইপিএল ঘিরে দেশে এবারও চলছে রমরমা জুয়ার আসর। শহর থেকে গ্রামের পাড়া-মহল্লা, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার বিভিন্ন ক্লাব, ফোন বা অনলাইনে প্রকাশ্যেই চলে এই জুয়া। মোবাইল ফোনে এবং বেটিং সাইটের অ্যাপস দিয়েও হচ্ছে টি-টোয়েন্টি ভার্সনের ক্রিকেট খেলা নিয়ে জুয়া।

জুয়ার টাকা নিয়ে বিরোধের জের ধরে হামলা, সংঘর্ষ এমনকি খুনের ঘটনাও ঘটছে। জুয়া আইনত নিষিদ্ধ। তবে ক্যাসিনো, হাউজিসহ অন্য জুয়ার ব্যাপারে পুলিশ-র‌্যাবের নজরদারি থাকলেও রাজধানীতে আইপিএল জুয়া নিয়ে নেই কোনো আভিযান। অবশ্য দেশের কয়েকটি এলাকায় আইপিএল জুয়া ভয়াবহ আকার ধারণ করায় অভিযানে নেমেছে পুলিশ ও র‌্যাব। কয়েকটি জেলায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তিন দিন আগে ফেনীর পরশুরামে আইপিএল জুয়া প্রতিরোধ করতে সন্ধ্যার পর কেবল নেটওয়ার্কের খেলার চ্যানেলগুলো বন্ধ রাখার উদ্যোগ নিয়েছেন পৌর মেয়র। কুড়িগ্রামে মাইকিং করে আইপিএল জুয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।

জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ‘ক্রিকেট খেলা নিয়ে যে জুয়া হচ্ছে সেটি আমাদের নজরে এসেছে। এক দিন আগে নওগাঁয় অনেক জুয়াড়িকে ধরা হয়েছে।’

আরও পড়ুন: মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ভুয়া ডাক্তার আটক

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরাও তথ্য পেয়েছি। আমাদের কমিশনার স্যার এই জুয়া বন্ধ করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। আমাদের নজরদারি শুরু হয়েছে।’

রাজধানীর খিলক্ষেত, তেজগাঁও, নাখালপাড়া, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, মালিবাগ, শান্তিনগর, পুরান ঢাকার কোতোয়ালি, বংশাল, লালবাগ, কামরাঙ্গীর চরসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সন্ধ্যার পর দোকানে-ক্লাবে আইপিএল জুয়া চলছে। সবচেয়ে বেশি টাকার জুয়া হয় মতিঝিল, উত্তরা, গুলিস্তান ও পুরান ঢাকার ক্লাবগুলোতে। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লার ক্লাব ও দোকানের আড্ডায় চলছে বাজি ধরার খেলা। ক্রিকেট খেলা ভালো বোঝে এমন তরুণরাই জুয়ার নেশায় পড়ছে বেশি। ১০-২০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকার বাজিতেও অংশ নিচ্ছে তারা।

খিলক্ষেতের আমতলা এলাকার চায়ের দোকানে টেলিভিশনে আইপিএলের খেলা দেখার পাশাপাশি জুয়া খেলায় অংশ নেন বাশার নামে এক যুবক। তিনি বলেন, এবার আগের চেয়ে কম বাজি হচ্ছে। তবে প্রতিরাতেই হয়। ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও হাজার টাকার বাজি ধরা হয়।

জহিরুল নামে আরেক আইপিএল জুয়াড়ি বলেন, বাজির নানা ধরন রয়েছে। মোবাইল ফোনেও বড় অঙ্কের বাজি হয়। বাজির টাকা তৃতীয় ব্যক্তি বা মিডিয়ার কাছে বিকাশে পাঠাতে হয়। পরে যে বাজি জেতে তাকে টাকা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় ওই পক্ষ ১০ শতাংশ কমিশন পায়। পুরান ঢাকায় এমন বেশ কিছু মিডিয়া আছে।

একাধিক সূত্র জানায়, ‘বেট৩৬৫ ডটকম’ নামে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওয়েবসাইটে সব ধরনের খেলার আপডেটের পাশাপাশি বাজি ধরার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেখানেও আইপিএলের বাজির হিড়িক। ‘বেট৩৬৫ লাইভ’ নামে এসেছে মোবাইল ফোনের অ্যাপ ভার্সন, যেখানে তরুণ-তরুণীরা আইপিএল নিয়ে দেদার জুয়া খেলছে। আরো কিছু অনলাইন জুয়ার সাইটে আইপিএলকেন্দ্রিক গেমিং চলছে। ২০১৬ সালে ক্রিকেট ঘিরে জুয়া খেলা হয় এমন ১২টি ওয়েবসাইট শনাক্ত করে ডিএমপি ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। পরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন (বিটিআরসি) ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করে দেয়।

দেশের বিভিন্ন স্থানের চিত্র : গত সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আইপিএলকে কেন্দ্র করে জুয়া খেলার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু করে কুড়িগ্রাম পুলিশ। রাজারহাট, নাগেশ্বরী ও উলিপুর উপজেলায় পুলিশ ২৫ তরুণকে আটক করে। এর পরও বন্ধ হয়নি এই জুয়া।

জানা গেছে, আগে বিভিন্ন বাজার এবং মোড়ের দোকান ও চা দোকানে বাজি ধরা হতো। সেটা হতো টিভি সেটের সামনে খেলা দেখতে দেখতে। পুলিশের ভয়ে এখন খেলার ধরন ও কৌশল বদল করেছে জুয়াড়িরা। দুর্গম এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকায় এখন মোবাইল ফোনে একজনকে সাক্ষী রেখে ম্যাচ প্রতি বাজি ধরা হচ্ছে।

কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান মাদক ও বাজির কবল থেকে রক্ষার জন্য সন্ধ্যার পর সন্তানরা যেন বাড়ির বাইরে না বের হয় তা নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানের চা দোকান ও মার্কেটগুলোতে রাত ৮টার পর থেকে জুয়ার আসর বসে। অনেক স্থানে মোবাইল ফোনে বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে জুয়া পরিচালনা করা হয়। পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের আফজল মিয়া জানান, প্রতিরাতে কলেজ গেট, উপজেলা চৌমুহনী পয়েন্ট ও গ্রামের দোকানগুলোতে আইপিএল খেলা চলাকালে জুয়া চলে। কমলগঞ্জ থানার ওসি আরিফুর রহমান বলেন, ‘আইপিএলের নামে জুয়া বা বাজি চলছে বলে শুনেছি। পুলিশ বিষয়টি নজরে রেখেছে।’

রংপুরের পীরগাছায় প্রায় ৫০টি স্থানে চলছে আইপিএল জুয়া। টাকা জোগান দিতে কেউ কেউ দামি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, সোনার গয়নাসহ নানা জিনিস বন্ধক রাখছে। আর সুদের কারবারিরাও থাকছে জুয়ার আসরের পাশেই। পীরগাছা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) দেবাশীষ রায় বলেন, এ জুয়া বন্ধে অভিযান শুরু হয়েছে।

মানিকগঞ্জের সিংগাইরে জয়মণ্টপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন বলেন, জুয়ার নেশায় পড়ে সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে পরিবার ও স্বাভাবিক জীবন থেকে ছিটকে পড়ছেন। এখনই ক্রিকেট জুয়া বন্ধ করতে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

সিংগাইর থানার ওসি রকিবুজ্জামান বলেন, ‘মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জুয়া পরিচালিত হওয়ায় জুয়াড়ি ও ডিলারদের শনাক্ত করা কঠিন। তবে ক্রিকেট জুয়া বন্ধে সব সময় পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

গত ১১ অক্টোবর গাইবান্ধার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জলের মোড়সংলগ্ন সাজু মিয়ার চায়ের দোকানে ক্রিকেট আইপিএল খেলা জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ। গত রবিবার নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়ালিয়া বাইপাস এলাকা থেকে চারজনকে আটক করে র‌্যাব।

ফেনীতে সন্ধ্যার পর খেলার চ্যানেল বন্ধ ফেনীর পরশুরাম ডিজিটাল কেবল নেটওয়ার্কের পরিচালক ওয়াসিম খোন্দকার বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন। জুয়াড়িদের পরিবারগুলোয় চলছে অশান্তি। এসব কারণে পৌর মেয়রের অনুরোধে আইপিএলের খেলা দেখানো চ্যানেল সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।’

পৌর মেয়র নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাজেল বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ আছে, বিভিন্ন দোকানপাটে ক্রিকেট খেলা দেখার নামে অনেকে বাজি ধরে জুয়া খেলায় মেতে উঠেছে। এসব বন্ধ করতে অনুরোধ জানিয়ে অনেক অভিভাবক টেলিফোনেও অভিযোগ করেছেন। আমি পৌরসভা থেকে লোক পাঠিয়েও এসব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি।’

পরশুরাম থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত হোসেন বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে।’

সূত্র : কালের কণ্ঠ
এন এইচ, ২৯ অক্টোবর

Back to top button