সনাতন

শারদ উৎসবে মেতে ওঠে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মানুষ

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

কুসংস্কার বনাম বিজ্ঞান প্রতিটি কুসংস্কার রীতি রেওয়াজ এর মধ্যে বিজ্ঞান জড়িয়ে রয়েছে!বছরে ছয় ঋতুর সামঞ্জস্য সন্ধিক্ষণ রেখেই বাঙ্গালীদের কৃষ্টি-কালচার ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন রয়েছে!ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বাঙ্গালীদের উৎসব ও সংস্কৃতি সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে বিজ্ঞান ও জড়িয়ে রয়েছে।বিজ্ঞান একদিকে যেমনি অভিশাপ অন্যদিকে আশীব্বার্দ। যেমন বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে এই সমাজের কোনো কিছু হয় না ,তেমনি অভিশাপ এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে। তাই বহু প্রাচীনকাল থেকে আদিম জনজাতির মানুষ প্রাকৃতিক শক্তি রূপে পূজা করেছিল, আজ আমরা সেই শক্তিকে মূর্তি পূজা করি। বাঙ্গালীদের উৎসব বা পুজো কে নিয়ে অভিন্ন অভিমত আছে গবেষকদের । তাই প্রতিটি লেখার আগে আমি গবেষণামূলক পরিস্থিতি দেখে নিয়ে আমার কলমে সে কথাগুলো উল্লেখ করি।

বাংলার প্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল ১৫০০ শতকের শেষের দিকে। কথিত আছে মালদহ বা দিনাজপুরের রাজা বা কোন জমিদারের সৌজনেই দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল। অপর একটি সুত্র অনুযায়ী বাংলার প্রথম দুর্গাপূজা করেছিলেন তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ, অপরপক্ষের দাবি নদিয়ার রাজা ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দের শরৎকালে প্রথম দুর্গাপূজার অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন। তবে বর্তমান যুগে  দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল-সহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু হিন্দু সমাজেও দুর্গাপূজা বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়।

এমনকী ভারতের অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহার রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবাসী বাঙালি ও স্থানীয় জনসাধারণ নিজ নিজ প্রথামাফিক শারদীয়া দুর্গাপূজা ও নবরাত্রি উৎসব পালন করে। এমনকী পাশ্চাত্য দেশগুলিতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালিরাও দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন। ২০০৬ সালে গ্রেট ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে “ভয়েসেস অফ বেঙ্গল” মরসুম নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় বাঙালি অভিবাসীরা ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এক বিরাট দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।তবে দুর্গাপুজো আমরা কেন করি? এর পিছনের প্রাচীনতম ইতিহাস বাকি আছে! সেই কথাগুলো আমি আজ আমার কলমে পরিবেশন করব।শরৎকালের দুর্গাপূজার একটি প্রাচীন গল্প প্রচলিত আছে হিউয়েন সাংকে নিয়ে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কোনো এক সময়ে শরৎকালে গঙ্গাপথে চলেছিলেন এই চীনা পর্যটক। পথে পড়লেন দস্যুর কবলে। দস্যুরা তাকে দেবী দুর্গার সামনে বলি দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে চলল। বলির আয়োজন সারা।

এমন সময় খ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনের আঙিনায়। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সব আয়োজন। দস্যুরা মাথা বাঁচাতে যে যেদিকে পারল দিল ছুট। সেই সুযোগে নিজেকে মুক্ত করে পালালেন হিউয়েন সাং।এই গল্প সত্য কি মিথ্যা বলা যায় না। তবে একথা সত্যি যে দুর্গাপূজার ইতিহাস একেবারেই অর্বাচীন নয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বলেছেন, ‘দুর্গাপূজা বৈদিক যজ্ঞের রূপান্তর, তন্ত্র দ্বারা সমাচ্ছন্ন।’ তাঁর মতে, বৈদিক যুগে প্রত্যেক ঋতুর প্রারম্ভে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হত। শরৎঋতুর আরম্ভেও হত। ‘এই শরৎকালীন যজ্ঞই রূপান্তরিত হইয়া দুর্গাপূজা হইয়াছে।’ তাঁর যুক্তি? তিনি বলেন, বৈদিক যজ্ঞ ও দুর্গাপূজার মধ্যে অনেক প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু উভয়ের উদ্দেশ্য একই। বৈদিক যজ্ঞের উদ্দেশ্য, ধন-ধান্য-পুত্র, রোগমুক্তি ও শক্তিনাশের শক্তি প্রার্থনা। দুর্গার পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র বলে, ‘আয়ুরারোগ্যং বিজয়ং দেহি দেবি নমস্তুতে। রূপং দেহি যশো দেহি ভাগ্যং ভগবতি দেহি মে। পুত্রান দেহি ধনং দেহি সর্ব্বকামাংশ্চ দেহি মে।।’ (হে ভগবতী, আপনাকে প্রণাম করি, আপনি আমাকে রোগমুক্ত করুন, বিজয়ী করুন, যশ ও সৌভাগ্য প্রদান করুন, পুত্র ও ধন দিন এবং আমার সকল কামনা পূর্ণ করুন।) যোগেশচন্দ্র আরও দেখাচ্ছেন, দুর্গাপূজার মন্ত্রে ‘যজ্ঞ’ শব্দটির পরিব্যাপ্তি কতটা। বৈদিক হিন্দুধর্ম ছিল যজ্ঞসর্বস্ব। দুর্গাপূজাতেও দেখি, দেবীকে যজ্ঞভাগ গ্রহণে আহ্বান জানানো হচ্ছে (‘দেবি যজ্ঞভাগান্ গৃহাণ’) এবং পশুবলি দেওয়ার সময় বলা হচ্ছে, যজ্ঞের নিমিত্তই পশুর সৃষ্টি (‘যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টাঃ তস্মিন্ যজ্ঞে বধোঽবধঃ’)। যোগেশচন্দ্রের তাই অনুমান, বৈদিক শারদ যজ্ঞই তন্ত্রের প্রভাবে পর্যবসিত হয়েছে আধুনিক দুর্গোৎসবে। হৃদয়ে যা জাগে, শরৎমেঘে তাই তো দেখা যায়।

এদিকে হিন্দু পুরাণে আছে, ভগবান ব্রহ্মা মহিষাসুর দৈত্যের কিছু ভালো কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন, মহিষাসুর ‘অমর’ বর প্রার্থনা করেছিল, ব্রহ্মা সরাসরি অমরত্ব বর না দিয়ে বর দিলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না। ভগবান ব্রহ্মা, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তার কাছ থেকে এমন বর পেয়ে মহিষাসুর ধরাকে সরাজ্ঞান করতে আরম্ভ করে। সে ধরেই নিয়েছিল যেহেতু নারীরা শারীরিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল এবং কোনো পুরুষের হাতে তার মৃত্যু নেই, তাই সে হবে অপরাজেয়, অমর।তার খুব ইচ্ছা হলো স্বর্গ-মর্ত্য জয় করার, দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিল, তার অত্যাচারে স্বর্গের দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে মহিষাসুরের অত্যাচার দেবতাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এভাবেই মহিষাসুর অপরাজেয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, এরপর সে স্বর্গের দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ন করতে শুরু করে।অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, তারা ব্রহ্মার দেওয়া কঠিন বরের ভেতরেই আলো দেখতে পান। ব্রহ্মা বর দেওয়ার সময় বলেছিলেন, কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না, এখানে নারীর কথা উহ্য রাখা হয়েছে। তার মানে নারীর হাতে মহিষাসুরের পরাস্ত হওয়ায় কোনো বাধা নেই। তখন ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব’র আহ্বানে দশভুজা যে নারী মূর্তির আবির্ভাব হলো, তিনিই দেবী দুর্গা।

যেহেতু মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরের সঙ্গে লড়তে হবে, দুই হাতে লড়াই করা সম্ভব নয় বলেই দেবী দুর্গাকে দশ ভুজারূপে কল্পনা করা হয়েছে। দুর্গা আবিভর্ূত হওয়ার পর দুর্গার দশ হাত মারণাস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হলো। শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, ইন্দ্র দিলেন তীর ধনুক, তরবারি, ঢাল, বিষধর সর্প, তীক্ষ্ন কাঁটাওয়ালা শঙ্খ, বিদ্যুৎবাহী বজ্র শক্তি এবং একটি পদ্মফুল।দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের মধ্যে দশ দিনব্যাপী মহাযুদ্ধ হয়েছিল, মহিষাসুরকে পরাস্ত করা রীতিমতো অসাধ্য হয়ে উঠেছিল, কারণ সে মায়ার খেলা জানত, দুর্গাকে বিভ্রান্ত করতে সে একেকবার একেক জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধারণ করছিল, দেবী দুর্গার জন্য যুদ্ধ ভীষণ কঠিন হয়ে উঠে যখন অসুরের ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়া মাত্র সেখান থেকে একই চেহারার আরেকটি অসুর জন্ম নিচ্ছিল।

এভাবে দুর্গার তরবারির কোপে রক্তাক্ত অসুরের প্রতি রক্তবিন্দু থেকে শত সহস্র অসুরের জন্ম হলো এবং দুর্গার দিকে ধেয়ে এলো। তখনই দেবী দুর্গা অন্য মূর্তি ধারণ করলেন, সে মূর্তির রূপ হলো আরও ভয়ঙ্কর, লম্বা জিভ, চার হস্ত কালী মূর্তি, যার প্রধান কাজই ছিল অসুরের রক্তবীজ মাটি স্পর্শ করার আগেই লম্বা জিভ বের করে চেটে খেয়ে ফেলা। এভাবেই রক্তবীজ থেকে অসুরের উৎপত্তি বন্ধ হয়ে গেল এবং যুদ্ধের দশম দিনে অসুর মহিষের রূপ নিয়েছিল, উপায়ান্তর না দেখে মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে এলো বিশালদেহী মানুষের রূপে, তখনই দেবী দুর্গার হাতের ত্রিশূল মহিষাসুরের বক্ষ্যভেদ করল। মহিষাসুরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে শান্তি ফিরে এলো। স্বর্গের দেবতারা দেবী দুর্গার নামে জয়ধ্বনি করিলেন। তবে আজ আমরা যে পুজোটি করি, সেই পুজোটা আমরা অনেকেই জানি অকালবোধন, রামচন্দ্র নিজে করেছিল।রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার কোন নির্দিষ্ট বিধান নেই। সেজন্যই হয়ত বাংলায় অকাল বোধনের কোন নির্দিষ্ট কোন “ভাব” নেই। কৃত্তিবাস ওঝার দৌলতে অবশ্য আমরা শিশুকাল থেকেই অকালবোধনের কথা শুনে এসেছি।

তিনি অত্যন্ত নিপূণভাবে সবিস্তারে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজার বিবরণ দিয়েছেন। সে বিবরণ অনেকটা এ রকম ছিল। অপহৃত পত্নী সীতাকে উদ্ধার প্রকল্পে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে শ্রী রামচন্দ্র লঙ্কা আক্রমণ করেছিলেন। রামচন্দ্র ভ্রাতা লক্ষণ ও বিপুল সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে লংকার সকল বড় বড় বীরদের নিধন করেছেন। তখন শ্রান্ত ও বিদ্ধস্ত রাবণ একা কোনক্রমে লঙ্কপুরী রক্ষা করে চলেছেন। এমন সময় একবার হনুমানের হাতে প্রচন্ড প্রহারে রাবণ জ্ঞান হারালেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে শ্রীরাবণ তখন মাতা অম্বিকার স্তব শুরু করে দিল। রাবণের কাতর প্রার্থণায় দেবী হৈমবতীর দয়া হল। তিনি কালীরূপে আবির্ভূত হয়ে রাবণকে নিজ ক্রোড়ে নিয়ে দিলেন অভয়বার্ত্তা। শয়তান রাবণকে দেওয়া দেবী কালীর অভয়বাণী সকল দেবদেবীদের মনে ভয় ও উৎকন্ঠার সৃষ্টি করল। এই দুঃসংবাদে স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্র প্রমাদ গুনলেন। বীর ইন্দ্র ব্রহ্মার কাছে গিয়ে রাবণকে দমন করার জন্য প্রার্থণা করলেন। সকলের প্রার্থণায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবাদিদেব ব্রহ্মা শ্রীরামচন্দ্রকে উপদেশ দিলেন – দুর্গাপূজা করো, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

শ্রীরামচন্দ্র উৎকন্ঠাসহ জানালেন – তা কেমন করে হবে, কারণ দুর্গাপূজার প্রশস্ত সময় হল বসন্তকাল, এখন হল শরৎকাল, আর শরৎকাল হল অকাল, তা ছাড়া বিধান হল অকালবোধনে নিদ্রাভঙ্গের পবিত্র সময় হলো কৃষ্ণানবমীতে। তা ছাড়া সুরথরাজা পূজা শুরু করেছিলেন প্রতিপদে, তা হলে এখন পূজা করব কি ভাবে?   ব্রহ্মা বললেন, “আমি ব্রহ্মা, বিধান দিচ্ছি, শুক্লাষষ্ঠীতে বোধন করো।” শুনে রাম মহাখুশি হলেন। দেবাদিদেব ব্রহ্মার আদেশে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকালবোধনের প্রস্তুতি নিলেন। শ্রীরামচন্দ্র নিজে দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরী করে পূজা করেছিলেন। ষষ্ঠীর সন্ধায় বেল গাছের তলায় হল দেবীর বোধন। অধিবাসের সময় রাম স্বহস্তে বাঁধলেন নবপত্রিকা। শ্রীরাম চণ্ডীপাঠ করে উৎসব করলেন । এই সপ্তমীর দিন সকালে স্নান করে রাম ‘বেদবিধিমতে’ পূজা করলেন। অষ্টমীর দিনও তাই। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাম সন্ধিপূজা করলেন। দুই দিনই রাতে চণ্ডীপাঠ করা হয়েছিল।

Back to top button