সম্পাদকের পাতা

উত্তর আমেরিকানদের অস্থিরতা

নজরুল মিন্টো

কানাডা ও আমেরিকার ভোর আমার কাছে খুব ভাল লাগে। টরন্টো, মনট্রিয়ল, নিউ ইয়র্ক যেখানেই গিয়েছি কাক ডাকা ভোর (যদিও এখানে কাক ডাকে না) আমাকে অবাক করে দিয়েছে। না নৈসর্গিক কোন দৃশ্য দেখে নয়; অবাক হয়েছি সাত সকালের জনস্রোত দেখে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় শীতের দেশের মানুষ ভোর চারটায় ঘুম থেকে ওঠে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। মানুষ দৌঁড়ৃচ্ছে, দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাসে উঠছে, ট্রেনে উঠছে। কি সে গতি মানুষের! মনে মনে ভাবি যে দেশের সকাল শুরু হয় গতির প্রতিযোগিতা করে সে দেশের উন্নতি না হয়ে পারে কি!

শহর জেগে ওঠে সূর্য ওঠার আগে। বাস ষ্টেশন, রেল ষ্টেশন, রেষ্টুরেন্ট, কফি শপগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে এ সময়টাতেই। সবাই যেন সকাল বেলার পাখি! কার আগে কে জাগে, কার আগে কে আসে! গল্প করার সময় নেই, পত্রিকা পড়ার সময় নেই, আমার মতো অনেকের নাস্তা খাওয়ার সময়ও নেই। নাস্তা খেতে হয় গাড়িতে। এক হাতে ষ্টিয়ারিং, অন্য হাতে স্যান্ডউইচ। রেষ্টুরেন্টে বসে চা-কফি খাওয়ার সৌভাগ্য গুটি কয়েক মানুষের। বেশিরভাগ লোক চলন্ত অবস্থায় অর্থাৎ বাসে-টে্রনে-গাড়িতে বসে কফি খায়। অর্থাৎ দৌঁড়ের উপর। বড় বড় কফির দোকানগুলো গাড়িওয়ালাদের জন্য ‘ড্রাইভ থ্রো’র সুযোগও রেখেছে যাতে গাড়িতে বসে জানালায় হাত বাড়িয়ে কফি নিয়ে ভোঁ।

পরিচিত অনেকের সাথে কথা বলে তাদের দৈনন্দিন কর্মতালিকার একটি চিত্র বের করেছি। অনেকের কর্মস্থল বাসস্থান থেকে কয়েক শ’ কিলোমিটার দূরে। তারা ঘুম থেকে ওঠে চারটায়। তারপর সেজেগুজে বের হতে যতক্ষণ লাগে। কেউ ড্রাইভ করে আসে, কেউ আসে সাবওয়ে বা কমিউটার ট্রেনে। প্রত্যেকেরই টার্গেট থাকে পনেরো মিনিট আগে অফিসে পৌঁছানো।

টরন্টোতে জেনিফার নামে এক মহিলা কাজ করতো আমার পাশের অফিসে। আসতো নায়াগ্রা ফলসের সন্নিকটের শহর সেন্ট ক্যাথারিন থেকে। প্রায় দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। সে ঘুম থেকে উঠে চারটায় কিংবা তারও আগে। ঝড়-বৃষ্টি যাই হোক একদিনও তার অফিস লেট হয়নি। এজন্যে সহকর্মীদের কাছে তার সুনাম আছে।

কর্মজীবী মানুষ রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম মনে করতাম এরা ঘুম কাতুরে। কেউ যখন বলতো রাতে ন’টার পর সে ফোন রিসিভ করে না; ভাবতাম নেশা করে বুঁদ হয়ে যায় এজন্যেই হয়তো ফোন ধরতে চায় না। এখন বুঝি কেন তারা এ কথা বলতো। অভিজ্ঞতার আলোকে আজ বলতে পারি যে, উত্তর আমেরিকার মানুষ কাজকে প্রাধান্য দেয়। সবকিছু একদিকে, আর বাকি কাজ অন্যদিকে। কাজের সময় কাজ, অবসরে স্ফূর্তি।

এবার আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের কথা একটু বলে নিই। সকালে ঘুম থেকে উঠবে বলে অনেকে মর্নিং শিফট পছন্দ না করে আফটারনুন অথবা নাইট শিফটে কাজ করে। গভীর রাত পর্যন্ত যদি টিভি দেখা আর টেলিফোনে আলাপ না-ই হলো তাহলে এ আর কেমন জীবন! তাদের ঘুম ভাঙে সকাল দশটা কিংবা এগারোটায়। এলার্ম বাজিয়েও ঘুম ভাঙানো যায় না। মুখ ধুইয়ে তারা যখন ওয়াশরুম থেকে বের হয় ততক্ষনে অফিস পাড়ায় লাঞ্চ আওয়ার শুরু হয়ে গেছে।

নিউ ইয়র্কে যখন ছিলাম তখন আমার সাথে কাজ করতেন আব্দুস সালাম নামে এক ভদ্রলোক। তিনি যেমন বাংলা জানেন তেমন ইংরেজীতেও চোস্ত। নানান বিষয়ে তার জ্ঞান দেখে আমি মুগ্ধ। কিন্তু একটা কারণে তার প্রতি খুব বিরক্ত ছিলাম সেটা হচ্ছে তিনি সময় মতো অফিসে আসতে পারতেন না। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো দেরী হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি প্রতিদিন নিত্য নতুন গল্প তৈরি করতেন। খুবই চমকপ্রদ গল্প। এমন গল্প তৈরি করতেন যেগুলো বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। যতই রাগ করি না কেন গল্প শোনার পর সব পানি হয়ে যেতো। আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রায় দুইবছর একসাথে কাজ করেছি কিন্তু তার বলা কোন গল্প ‘রিপিট’ হয়নি।

শুনুন দু-একটা তাহলে:

-সালাম সাহেব আপনি তো আজ ৯টায় অফিসে আসার কথা! জানেন যে, আমার অ্যাপোয়েনমেন্ট আছে।
– হ্যাঁ জানি এবং বাসা থেকে ঠিকই রওয়ানা দিয়েছিলাম কিন্তু হঠাৎ করে সাবওয়ে আটকে গেলো। প্রায় আধঘন্টা আটকে ছিলাম। কি যে ভয়ংকর অবস্থা! কে একজন সুইসাইড করেছে।
ব্যাস, রাগ কি আর দেখানো যায়! উল্টো সে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি শোনার জন্য আগ্রহ দেখাই।

– সালাম সাহেব, আজকে আপনি লেট করলেন কিভাবে? ব্যাংকে যাবেন কখন?
– আর বলবেন না। সারারাত ঘুমুতে পারিনি। ঐ যে আমার ওপরের ফ্লাটে যে বাঙালি ফ্যামিলিটা থাকে ভেবেছিলাম খুবই ভদ্র বোধহয়। কিন্তু না, লোকটা বড্ড বদমেজাজি। জানেন, সে ভদ্রমহিলার গায়ে হাত তুলেছে! শেষ পর্যন্ত পুলিশ ডাকতে হলো। ব্যাপারটা সামলাতে সামলাতে ভোর হয়ে গেছে।
রাগ কি আর রাখা যায়? উল্টো ঐ ফ্যামিলির কাহিনী শোনার জন্য তাঁকে চা বানিয়ে খাওয়াতে হয়।

-সালাম সাহেব আজ কি হলো?
– কেন খবর পাননি? আজাদ আর মজিদকে তো ইমিগ্রেশন টাস্কফোর্স ধরে নিয়ে গেছে। ওরা এখন ডিটেনশন সেন্টারে। নূরজাহানের বেশ কিছু টাকা জমা আছে আজাদের কাছে ওগুলো উদ্ধার করতে হবে।
-নূরজাহান কে?
-আরে ঐ যে, বাণিজ্যমেলায় এসে থেকে গিয়েছিলো যে মেয়েটি।

সালাম সাহেব পেরেশান! কত বড় গুরুদায়িত্ব তার! দেশ ও জাতিকে নিয়ে তিনি সব সময় চিন্তিত! শুধু চিন্তা নেই তিনি যেখানে কাজ করেন; সে অফিসের।
সংক্ষেপে মাত্র তিনটে কাহিনী বললাম। এরকম কয়েকশ’ কাহিনী আমার স্মৃতির সংগ্রহশালায় জমা পড়ে আছে।

কেউ মানুন বা নাই মানুন, আমি মনে করি হুজুগের ব্যাপারে বাঙালি, আমেরিকান, কানাডিয়ানদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। সব দেশের মানুষের চরিত্র মূলত এক। কোন একটা উৎসব বা উপলক্ষ পেলেই হলো। কেনাকাটার জন্য পাগল হয়ে যায় সবাই। যেদিন থেকে জিংগেল বেল এর বাজনা বাজানো শুরু হলো সেদিন থেকে কেনাকাটার ধুমও পড়ে যায়।

লক্ষ্য করছি- আজকাল মানুষ কাপড়-চোপড়ের চাইতে বিনোদন, খেলাধুলা এবং টেকনোলজির দিকেই নজর দিচ্ছে বেশি। মানুষ পেটের ক্ষুধার চাইতে মনের ক্ষুধাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

উত্তর আমেরিকায় ক্রিসমাসের পরদিনকে বলা হয় বক্সিংডে। এদিন বিপুল পরিমাণ পণ্য কেনাবেচা হয়ে থাকে। ভোররাত, কখনো পূর্বরাত থেকেই বিভিন্ন শপিং সেন্টার ও দোকানের সামনে ক্রেতাদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দোকান খোলার পর হুমড়ি খেয়ে পড়ে সবাই। বক্সিং ডে মানে শুধু হ্রাসকৃত মূল্যে জিনিষ কেনা নয়; ঐদিনটিকে বেচা-কেনার উৎসবও বলা যেতে পারে।

জিনিষ কেনা-কাটা করতে যে একটা মজা আছে তা বুঝা যায় বক্সিং ডে-তে। শপিং মলগুলোর উৎসব মুখর পরিবেশটা আমার কাছে ভাল লাগে। এ সময়টাতে কানাডা-আমেরিকায় প্রচন্ড ঠান্ডা থাকে ও প্রচুর তুষারাপাত হয়। বৈরি আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে শত শত মানুষের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি পাগলামি মনে হলেও অনেকের কাছে বিষয়টি আনন্দের। বিরাট মূল্য হ্রাসের বিশাল বিজ্ঞাপন দেখে লোকজন আকৃষ্ট হয়ে লাইন ধরে।

ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব শপিং সেন্টারস কর্তৃক জরিপে দেখা গেছ, কানাডিয়ানরা বক্সিংডে-তে বছরের সবচেয়ে বেশী কেনাকাটা করে। হ্রাসকৃত মূল্যে কেনার লোভ এবং একই সাথে বক্সিংডে-কে কেনা কাটার উৎসব হিসেবে মনে করে কানাডিয়ানরা ঐদিন দল বেধে শপিং মলগুলোতে ভিড় করে।

Back to top button