শিক্ষা

খুলছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার ভবিষ্যৎ কী

মাছুম বিল্লাহ

ঢাকা, ০২ এপ্রিল – পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ মার্চ খুলছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ঈদুল ফিতরের পর ২৩ মে শুরু হবে। সে হিসেবে ৪৩০ দিন পর স্কুল-কলেজ ও ৪৩১ দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে অতি সম্প্রতি চলমান কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সার্বিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সময়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। চলমান মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এবারের (২০২১) ৩০ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা ছিল। তবে তা আর হচ্ছে না। করোনা বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে শিক্ষামন্ত্রী জানান। এর আগে ২৭ ফেব্রুয়ারি (২০২১) আন্তমন্ত্রণালয় সভাশেষে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন করোনার নমুনা শনাক্ত হার ছিল ৩.৩০ শতাংশ। কয়েক দিন ধরে প্রতিদিনই শনাক্ত হার বাড়ছে। ২৪ মার্চ এটি ছিল ১২.৯৪ শতাংশ। কোভিড সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির পরামর্শ ছিল করোনার নমুনা শনাক্ত হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করার।

আরও পড়ুন : এসএসসির ফরম পূরণ আজ শুরু

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার পর কয়েক ধাপে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২২ জানুয়ারি ২০২১ করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে গাইডলাইন প্রকাশ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। এ গাইডলাইন অনুসরণ করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। স্কুল-কলেজগুলোতে ৩৯ পাতার গাইডলাইন পাঠিয়ে বলা হয় যে, ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্কুলগুলো প্রস্তুত রাখতে; যাতে যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতিও নিয়েছিল, কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি গোটা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে। বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতির মতো শিক্ষা খাতকেও বিশাল এক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শিক্ষাসচিব বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এখনো সেটাই অগ্রাধিকার পারে।’ ১৫ এপ্রিল ২০২১ থেকে রোজ শুরু হতে পারে। এই সময়ে সাধারণত স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। ঈদের ছুটির পর ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৭ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খোলার ঘোষণা দেওয়া আছে। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে করোনার সংক্রমণ কমে গেলে ঈদের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই স্কুল-কলেজ খোলা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সম্প্রতি ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে স্কুল-কলেজের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেগুলো বন্ধ আছে; সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে। অন্যান্য কার্যক্রম সীমিত রাখতে হবে। যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা বন্ধ রাখতে হবে। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় ঘোষিত তারিখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করছে। তাই আমরা জাতীয় পরামর্শক কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বলছি।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে না পারায় চলতি বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিলেবাস এরই মধ্যে সংক্ষিপ্ত করে আনা হয়েছে। সব বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা বাতিল করে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। বাতিল করে দেওয়া হয়েছে ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলের ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা। ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নির্বাচনী পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্কুল-কলেজ এ মুহূর্তে খোলা হলে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। যে কারণে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাও ১৬ মার্চ এক আদেশে বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টরকে এ নির্দেশসংবলিত চিঠিতে বলা হয় ‘কোভিড-১৯’ অতিমারির কারণে পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে এবং এখনো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনুকূলে না আসায় বাংলাদেশে বাংলা মিডিয়াম ও সাধারণ ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো পাবলিক পরীক্ষা আপাতত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। অন্যদিকে বর্তমানে কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে যুক্তরাজ্য ও আমাদের প্রতিবেশী অন্যান্য দেশেও ক্যামব্রিজ পদ্ধতির পরীক্ষা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এ সময়ে আমাদের দেশেও এ পরীক্ষা গ্রহণ করা যুক্তিসংগত হবে না মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠেয় ক্যামব্রিজ পদ্ধতির ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষগুলো গ্রহণ না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। এসব পরীক্ষা আপাতত স্থগিতই থাকবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইঙ্গিত দিয়েছে। এভাবে ২০২০ ও ২১ শিক্ষাবর্ষে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে সর্বস্তরের শিক্ষাসূচি। এতে দেশি স্ট্রিমেরই প্রায় পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরো শোচনীয়। প্রত্যক্ষ হিসাব নিয়ে দেখেছি এনজিও পরিচালিত ও সরকারের ‘সেকেন্ড চান্স’ এডুকেশনের বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থীদের কোনো হদিস কোনোভাবেই পাওয়া যাচ্ছে না, তার মানে হচ্ছে তারা আর স্কুলে আসছে না। ঠিকমতো পড়াশোনা ও মূল্যায়ন ছাড়া শিক্ষার্থীরা পরবর্তী শ্রেণিতে উঠে গেছে। রয়ে গেছে বিশাল লার্নিং গ্যাপ। জাতির এই ভয়াবহ ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, সেই ধরনের কোনো পরিকল্পনা কিন্তু দৃশ্যমান হচ্ছে না।

সাধারণত বছরের শুরুর দিকে অর্থাৎ জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যালয়ে নানা ধরনের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বনভোজনসহ বেশ কিছু কর্মকান্ডে শিক্ষার্থী এবঙ শিক্ষকরা ব্যস্ত থাকেন। এগুলোও শিক্ষাজীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ। এগুলোও বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো না আর অ্যাকাডেমিক বিষয়ে তো হাতই দেওয়া গেল না। কী হবে শিক্ষার্থীদের? কী হবে শিক্ষার? কারোর কাছেই কোনো সদুত্তর নেই, থাকার কথাও নয়। তার পরও ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব রয়ে গেছে সঠিকভাবে কিছু গাইডেন্স দেওয়ার। প্রচলিত অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের কিছুটা ব্যস্ত রাখে সত্য কিন্তু এর প্রকৃত ফল কী, এর আসল ইমপ্যাক্টের ওপর সার্ভে নেই, গবেষণা নেই। কিন্তু করতে তো হবে। তা না হলে যে লার্নিং গ্যাপ, মানসিক ব্যাধি, সামাজিক অস্থিরতা, মেধাহীনতার আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেগুলো অমূলক নয়।

গত বছরের মে মাস থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা ও জুলাই মাস থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু সব শিক্ষার্থীর কাছে প্রয়োজনীয় ডিভাইস না থাকা, দুর্বল ও ধীরগতির ইন্টারন্টে এবং ইন্টারনেটের উচ্চমূল্যের কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন ব্যাচের ভর্তিও পিছিয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে অন্তত ৫০০ পরীক্ষা স্থগিত করেছে। বড় ধরনের সেশনজটে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। এসব কারণে করোনাকালে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে প্রচন্ড বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে গ্রাম-শহর ও ধনী-দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। শহরের শিক্ষার্থীরা টেলিভিশনের ক্লাস না দেখলেও অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছে। এমনকি পরীক্ষাও দিচ্ছে। অনলাইনে প্রাইভেট পড়ছে অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা এসবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বিদ্যালয় খোলা থাকলে অন্তত কিছু না কিছু তারা শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা থেকে পেত, সেটি না থাকায় প্রচলিত গ্যাপ বেড়েই চলেছে। এক দশক ধরে পূর্বনির্ধারিত শিক্ষাসূচি অনুযায়ীই চলছিল শিক্ষাব্যবস্থা, হঠাৎই সেখানে ছেদ পড়ল। প্রতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। ফল প্রকাশের পর মোটামুটি নির্দিষ্ট একটি সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতেন শিক্ষার্থীরা। পুরো বিষয়গুলোই ধমকে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অনলাইন ব্যবস্থা যে সেই অর্থে উন্নত নয় এবং একটি বিশেষ অংশকে সঙ্গে নিতে পারছে না, এটি একটি বাস্তবতা। আবার অ্যাসাইনমেন্ট যে প্রকারে জমা দেওয়া হচ্ছে, তাও আমাদের অজানা নয়। কাজেই এই দুটো বিষয়ের কথা উল্লেখ করে কিন্তু আমরা প্রকৃত লার্নিং ক্রাইসিসকে এড়াতে পারছি না। কী আমাদের করা উচিত, কীভাবে করা উচিত এবং কাদের জন্য কী করা উচিত, কোন এলাকার জন্য কী করা উচিত ইত্যাদি বিষয়গুলো এখন সামনে চলে এসেছে। আলোচনা করতে হবে গুরুত্ব দিয়ে এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে।

সূত্র : প্রতিদিনের সংবাদ
এন এইচ, ০২ এপ্রিল

Back to top button