সাহিত্য

ম্রো তরুণের কলমে দেশে রেংমিটচ্য ভাষার প্রথম অভিধান

দেশের পার্বত্যাঞ্চলের এক জাতিগোষ্ঠী ম্রো। তাদেরই একটি ভাষা রেংমিটচ্য। ম্রোদের মধ্যে প্রচলিত মূল ভাষার বাইরের এ ভাষাটি বিলুপ্তপ্রায়। কারণ মাত্রই ছয়জন মানুষ রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলে এখন।

বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শ্রুতির আড়ালে থাকা এই রেংমিটচ্য ভাষার প্রথম অভিধান গ্রন্থনা করলেন ইয়াংঙান ম্রো। ম্রো বর্ণমালায় লেখা এই অভিধানের নাম ‘মিটচ্য তখক’। বাংলায় রেংমিটচ্য ভাষা। ১০ বছরের প্রচেষ্টায় অভিধানটি লেখা সম্পন্ন করেছেন লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো। ম্রো ভাষায় প্রথম বইয়েরও লেখক তিনি।

এখন মাত্র যে ছয়জন মানুষ রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলেন অভিধানটির প্রচ্ছদে তাঁদের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন মাংপুন ম্রো, কুনরাও ম্রো, রেংপুন ম্রো, মাংওয়ই ম্রো, আরেক কুনরাও ম্রো ও থোয়াইংলক ম্রো।

প্রচ্ছদে বাবার ছবি দেখে খুবই খুশি মাংপুন ম্রোর তরুণ ছেলে সিংরা ম্রো। বললেন, ‘এটা খুব আনন্দের ও গর্বের ব্যাপার। বইটি আমাদের ভাষা রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।’

অভিধানটিতে শব্দ আছে প্রায় ৩৪০০। ম্রো ভাষার পাশাপাশি শব্দগুলোর বাংলা অনুবাদও আছে। কৃষি, সংস্কৃতি, ধর্ম, খাবার, জিনিসপত্র, ফলমূলসহ বিভিন্ন বিষয়ে দৈনন্দিন জীবনে রেংমিটচ্য মানুষদের ব্যবহৃত শব্দগুলো তুলে এনেছেন অভিধানকার ইয়াংঙান ম্রো; পাশাপাশি আছে সাধারণ আলাপ-আলোচনায় ব্যবহৃত কিছু কথোপকথনও।

অভিধানটি প্রকাশিত হয়েছে বান্দরবানের বনতুলি প্রিন্টার্স থেকে। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করেই এটি প্রকাশ করেছেন ইয়াংঙান ম্রো। আজ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিধানটির মোড়ক উন্মোচন করা হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য ভাষা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন ইয়াংঙান ম্রো। এর পর থেকে গবেষণা ও লেখালেখিকেই মূল কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রথম বই ‘রিইয়ুং খতি’। ম্রো জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত ‘ক্রামা’ ধর্ম সম্পর্কে সংকলনগ্রন্থ এটি। ক্রামাদি, ম্রো লোকগল্প, জুম পাহাড়ের গল্পসহ এ পর্যন্ত ম্রো ও বাংলায় লেখা তাঁর ২৯টি বই প্রকাশিত হয়েছে। গত বছর লিখেছেন ম্রো ভাষার প্রথম ব্যাকরণ বই ‘ততোং’।

ছাত্রাবস্থায় পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় গিয়ে ম্রো সমাজে প্রচলিত গল্প, ছড়া, লোকগল্প আর রীতি-নীতি সংগ্রহ করতেন ইয়াংঙান। স্নাতকোত্তর পাস করার পর সিদ্ধান্ত নেন, চাকরির পেছনে না ছুটে খামার করবেন আর গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করে যাবেন ম্রোদের পুরনো গল্পগাথা।

ইয়াঙানের এই ভাবনার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ডর্টমুন্ড কলেজের অধ্যাপক ডেভিড এ কে পিটারসনেরও ভূমিকা ছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে যাওয়া-আসা ডেভিডের। ম্রো ও খুমিদের ভাষা সংরক্ষণ করা নিয়ে কাজ করতেন তিনি। সেই সূত্রেই ইয়াঙানের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। ২০১৪ সালে ডেভিড বাংলাদেশে আসার পর ইয়াংঙানকে রেংমিটচ্য ভাষা নিয়ে তাঁর কাজ করার আগ্রহের কথা জানান। মজার ব্যাপার, নিজে ম্রো হলেও এর আগে তাঁদের গোষ্ঠীতে রেংমিটচ্য নামে কোনো ভাষা আছে বলে জানতেনই না ইয়াংঙান। ডেভিড তাঁকে বলেন, ১৯৭০ সালের দিকে লেখা এক জার্মান ভাষাবিদের বই থেকে রেংমিটচ্য ভাষার কথা জেনেছিলেন তিনি। ভাষাটি বিলুপ্তপ্রায়। ডেভিডের কাছ থেকে ইয়াংঙান আরো জানলেন, রেংমিটচ্য ম্রো ভাষা থেকে আলাদা হলেও এই ভাষার মানুষরাও জাতি হিসেবে ম্রো। ভাষাটির সঙ্গে খুমি ভাষার কিছু মিল আছে। আর এখনো রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলা নগণ্যসংখ্যক মানুষ থাকেন আলিকদমের দুর্গম তৈন খালের আশপাশে এবং নাইক্ষ্যংছড়িতে।

ডেভিড পিটারসনের সঙ্গেই ইয়াংঙান একদিন গেলেন আলিকদমে রেংমিটচ্যভাষীদের খুঁজতে। সেখানেই পাওয়া গেল ঙুইপংকে। ঙুইপংদের পূর্বপুরুষ রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলতেন। কিন্তু তিনি আর রেংমিটচ্য বলতে পারেন না। পরের প্রজন্ম তাঁর সন্তানরা তো না-ই। ঙুইপংয়ের মাধ্যমেই রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বলা কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হলো ডেভিড ও ইয়াঙানের।

এর পর থেকে ডেভিড প্রায়ই ইয়াংঙানকে তৈন খালের দুর্গম এলাকাসহ আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন প্রত্যন্ত স্থানে পাঠাতেন রেংমিটচ্য ভাষার মানুষদের খুঁজতে। ডেভিড বলতেন, ‘রেংমিটচ্য ভাষা শিগগিরই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে।’

কালের কণ্ঠকে ইয়াংঙান বলেন, ‘রেংমিটচ্যভাষীদের কাজ করতে গিয়ে তাঁদেরই একজন হয়ে গেলাম। নিজেদের মাতৃভাষা সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তাঁরা একসময় আমাকে বললেন এই ভাষার একটা ডিকশনারির ব্যবস্থা করে দিতে। তখন তাঁদের কথা দিয়েছিলাম। এত দিন পর সেটা আলোর মুখ দেখল।’

র্দীঘদিন ধরে রেংমিটচ্যদের শব্দ সংগ্রহ করে লিখে রেখেছিলেন ইয়াংঙান। লিখতেন ম্রো হরফে। কারণ রেংমিটচ্য ভাষার নিজের বর্ণমালা নেই। রেংমিটচ্য ভাষার মানুষ ম্রো বর্ণমালা পড়তে পারে। ফলে এই ভাষার গ্রন্থবদ্ধ শব্দভাণ্ডার তাদের কাজে আসবে বলে মনে করেন ইয়াংঙান।

আইএ/ ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

Back to top button