অপরাধ

দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান ৫০০ কোটি টাকা কানাডায় পাচার করেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে

ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর- বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা কানাডায় পাচার করে এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরিফ হাসান ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছেন। এছাড়া আরিফ ও তার বাবার নামে ১২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদকের তথ্য অনুযায়ী দেশে ও কানাডায় বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক আরিফ হাসান। সংস্থাটি জানায়, পাচারকৃত অর্থ থেকে ৩.৭ মিলিয়ন ডলারে টরন্টোতে তিনি যে বাড়িটি কিনেছেন তার তথ্য তাদের কাছে আছে।

দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘আরিফ হাসানের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে তার মালিকাধীন হাসান টেলিকমের ৩৩৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়া আরিফ হাসান, তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজের নামে কানাডার টরন্টোর নর্থ ইয়র্কের ৮৩ হলিউড অ্যাভেনিউয়ে একটি বাড়ি কেনার তথ্য অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। জাল-জালিয়াতি করে আয় করা টাকায় বাড়িটি কেনা হয়েছে। এর পাশাপাশি আরিফ হাসান ও তার বাবা আবদুল আজিজের নামে ১২৮ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই সম্পদের বৈধ উৎস সম্পর্কে কোনও তথ্য জানাতে পারেননি তারা।’

অবৈধ সম্পদ অর্জন, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, অর্থপাচার আর সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আরিফ হাসানের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয় গত বছরের ১৮ নভেম্বর। ওই মাসেই তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তখন আরিফ হাসানের সাউথ ইস্ট ব্যাংকের মৌচাক শাখার ব্যাংক হিসাবে থাকা ১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।

আরিফ হাসানের জন্মস্থান কুমিল্লা। তার বাবার নাম আবদুল আজিজ এবং মায়ের নাম মালেকা পারভীন। ঠিকানা দু’টি হলো বাড়ি-১৮/এ, রোড-৪৪, গুলশান উত্তর, ঢাকা-১২১২ এবং অ্যাপার্টমেন্ট-বি-৩/ডি, বাসা-১৫, পুরাতন ডিওএইচএস, বনানী। পাসপোর্টে আরিফের জন্ম তারিখ হলো ১৯৭৪ সালে ২৭ জুন। তিনি যে পাসপোর্ট ব্যবহার করে কানাডা সফর করেন সেটির ইস্যুর তারিখ হলো ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর।

আরিফের ঋণ জালিয়াতি:
ন্যাশনাল ব্যাংক মহাখালী শাখায় আরিফের মালিকাধীন হাসান টেলিকমের নামে ২৭৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। ডাইরেক্ট হু হোম প্রকল্পের আওতায় ৪৭৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ওয়ার্ক পারমিটের বিপরীতে ন্যাশনাল ব্যাংকের মহাখালী শাখায় ঋণের আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর ব্যাংকের পর্ষদ সভায় হাসান টেলিকমের অনুকূলে ২৭৫ কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদি ওভারড্রাফট (ওডি) ঋণ অনুমোদন করা হয়। ২৯ নভেম্বর আরিফের ব্যাংক হিসাবে ১০০ কোটি টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরে পুরো টাকা ১৯টি চেকের মাধ্যমে তুলে নেন আরিফ। ২ ও ৩ ডিসেম্বর যথাক্রমে ১০০ কোটি ও ৭৫ কোটি টাকা একইভাবে আরিফের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে চেকের মাধ্যমে ওই টাকাও তুলে নেন আরিফ।

দুদক বলছে, আরিফের টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার ভি-৮ গাড়িটি বাংলাদেশে খুব বেশি ব্যবহার হয় না। এর আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। গত বছর তার সম্পদের অনুসন্ধান শুরু হলে গাড়িটি লুকিয়ে ফেলেন আরিফ। গাড়িটির নম্বরের সূত্র ধরে দুদক জানতে পেরেছে নিজের টাকায় কেনা হলেও রেজিস্ট্রেশন অন্যের নামে করেছেন আরিফ। গাড়িটি বর্তমানে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

দুদক জানায়, জালিয়াতি করা টাকায় আরিফ হাসান নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আরিফ ও তার বাবার নামে গুলশানে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আছে জমি। দেশ টিভিতে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দেশ এন্টারটেইনমেন্টে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ ৬ লাখ টাকা। হাসান টেলিকমে শেয়ার বাবদ বিনিয়োগ ৮ লাখ টাকা। ৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র আছে। এফডিআর, বিভিন্ন ব্যাংকের জমা এবং হাতে নগদ বাবদ ১২০ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৮ টাকা আছে। কিন্তু কোনও কিছুরই বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি তারা।

আরিফের পাচারকৃত অর্থে কেনা ৩.৭ মিলিয়ন ডলারের নর্থ ইয়র্কের ৮২ হলিউড এভিনিউর বাড়ি

টরন্টোতে আরিফের বাড়ি কেনার কাহিনী
আরিফ হাসান কানাডার অভিজাত এলাকায় যে বাড়িটি কিনেছেন তা বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে কেনা বলে দুদক জানিয়েছে।
বাড়ি কেনার নথির তথ্য: ২০০০ সালের ৮ মে থেকে ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আরিফ হাসানের কেনা বাড়িটি হাত বদল হয় চারবার। সর্বশেষ হাত বদলে বাড়ির মালিক হন আরিফ। নথির তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর টরন্টোর নর্থ ইয়র্কের ৮২ হলিউড এভিনিউর এ বাড়িটি গেল বছরের সেপ্টেম্বরে আরিফ হাসান টরন্টোতে উপস্থিত থেকেকেনেন। পরে পুরনো বাড়ি সংস্কার করে নতুন রূপ দেন। সংস্কার করে বাড়িটির নতুন রূপ দিতে আরিফ হাসান খরচ করেছেন ১ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার। বাড়ি বেচাকেনার লিস্টিংয়ের (নথিভুক্ত) বাইরে প্রাইভেট ডিলিংয়ের (ব্যক্তিগত যোগাযোগ) মাধ্যমে নগদ অর্থে বাড়িটি কেনা হয়েছে।২০০০ সালের ৮ মে বাড়িটি কিনেছিলেন মারিয়া লার্চ ও অগাস্ট লার্চ নামে দুই ব্যক্তি। ৩ লাখ ৫৮ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কিনেছিলেন তারা। ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারা বাড়িটি বিক্রি করে দেন। ক্রেতা ছিলেন জরা ইজাদিয়ান। ২৪ লাখ কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর জরা ইজাদিয়ানও বাড়িটি বিক্রি করেন। এবার বাড়ির ক্রেতা ছিলেন রাফে নাদের। ২৫ লাখ ৫৫ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন তিনি। সর্বশেষ বাড়িটি হাত বদল হয় ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। রাফে নাদেরের কাছ থেকে ৩৬ লাখ ৫০ হাজার কানাডীয় ডলারে বাড়িটি কেনেন দেশ টিভির পরিচালক আরিফ হাসান। বাড়ির মালিকানায় আরও দু’জনের নাম আছে। তারা হলেন আরিফ হাসানের স্ত্রী এমিলি ফয়েজ ও সুফিয়া চৌধুরী নামে অন্য এক মহিলা।

৬ হাজার স্কয়ার ফুট জায়গার ওপর আরিফ হাসানের বাড়িটির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৩ কোটি ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৯৮২ টাকা। আর সংস্কার বাবদ খরচ হয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ কোটি ৪৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৪৭ টাকা। তবে এ বাড়িতে থাকেন না আরিফের পরিবার। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় আরিফ দেশে থাকলেও তার স্ত্রী এমিলি ফয়েজ থাকছেন টরন্টোতেই। অন্য একটি বাড়িতে তারা আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।

Back to top button