যুক্তরাজ্য

ব্রিটেনে যতো শহীদ মিনার

লন্ডন, ২২ ফেব্রুয়ারি – ইস্ট লন্ডনের আলতাফ আলী পার্ক। যার পাশ থেকে হেঁটে যাওয়ার সময়ে বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেন আপনি। মনের অজান্তেই গর্ববোধ হবে, কারণ আপনি একজন বাঙালি। আপনি গর্বিত মনে ভাববেন, আপনার আছে বাংলা ভাষা, বর্ণমালা আর সংস্কৃতি। আর এই বিস্ময় ও গর্ববোধের পেছনে মূল কারণ আলতাব আলী পার্কের শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে থাকা বাঙালীর গর্বের শহিদ মিনার।

বাঙালির বাংলা ভাষার গর্বের শহিদ মিনার আজ আন্তর্জাতিক মর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রাণকেন্দ্রে। যার ব্যতিক্রম নয় ব্রিটেন। দেশের বাইরে এই বিলেতে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ওল্ডহ্যাম, লন্ডন, লুটন, বার্মিংহাম, কার্ডিফে নির্মাণ করা হয়েছে ৫টি স্থায়ী শহিদ মিনার। এছাড়াও বিভিন্ন শহরে ভাষা দিবস উপলক্ষে নির্মাণ করা হয় অস্থায়ী শহিদ মিনার।

জীবিকার সন্ধানে ৭০ থেকে ৮০ বছর আগে এই ব্রিটেনে বাঙালিদের আগমন। আর তাই এতো বছরে বাংলাদেশিরা এখানে তৈরি করেছে বৃহৎ সুসংহত কমিউনিটি। বাঙালিদের অর্জন এখন মূলধারায় স্বীকৃত। ব্রিটিশ বাংলাদেশিরা যেভাবে মূলধারার সাথে মিশে যাচ্ছে, তেমনি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে বাঙালি জাতিসত্তা। এখানে জন্ম নেয়া, বেড়ে উঠা সফল বাংলাদেশিরা বাঙালি হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে এখন আর মূলধারায় কুণ্ঠাবোধ করে না। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা চতুর্থ প্রজন্ম বুঝতে শিখেছে তাদের সর্বশেষ পরিচয় তারা বাঙালি।

তাইতো ব্রিটেনে এখন বাংলা পঞ্চম বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করতে হয় আগে যেখানে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে আলতাব আলী পার্ক বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যুক্তরাজ্য শাখার দখলে থাকতো এখন সেখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ থেকে বড় হয়ে আসা প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের হাত ধরে চতুর্থ এবং পঞ্চম প্রজন্মের উপস্থিতি দেখা যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামে স্থাপিত হওয়া প্রথম শহিদ মিনার থেকে শুরু করে ব্রিটেনের ৫টি স্থায়ী শহিদ মিনার গৌরবান্বিত হয় মানুষের ভালোবাসায়… ফুলে ফুলে ভরে উঠে শহিদবেদী। ব্রিটেনের ৫টি স্থায়ী শহিদ মিনার ১৯৫২ সালের ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহিদ মিনার ম্যানচেস্টারের ওল্ডহ্যামে
এক সময় লন্ডনের ইষ্ট-এন্ড, ওল্ডহ্যাম, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, ব্রিস্টল, প্রভৃতি এলাকার মানুষ অগ্নিমশালে আলোকিত আর প্রজ্বলিত হয়ে জমায়েত হতো বিভিন্ন বাংলাদেশি সেন্টার কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে। তৈরি করতো কাপড়ে ঢাকা কাঠের শহিদ মিনার। অস্থায়ী সেইসব শহিদ মিনারে ব্রিটেনের বাঙালিরা অর্পণ করতো তাদের হৃদয় নিংড়ানো অর্ঘ্য। উৎসর্গ করতো একুশের কবিতা।

ম্যানচেস্টারে বসবাসরত বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ফারুক যোশী ওল্ডহ্যামে প্রথম শহিদ মিনার স্থাপনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলেন, প্রতিবছরের এই অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহিদ মিনারের স্থায়ী রূপ দিতে অনেকেই চেয়েছিলেন। কিন্তু হয়ে উঠছিলো না। অবশেষে ওল্ডহ্যাম শহরের বাঙালি যুবকরা এরকম একটি স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করতে উদ্যোগী হয়। ১৯৯০ সালে ইয়ুথ এসোসিয়েশন প্রথম দাবি তুলে এই দেশের বাইরে প্রথম শহিদ মিনার স্থাপনের। এজন্য নিজস্ব উদ্যোগে কিছু ফান্ড কালেক্ট করা হয় বলে জানান সেসময়ে ইয়ুথ এসোসিয়েশনে যুক্ত হওয়া কামাল হোসেন। এ শহরের বাঙালি যুবকরা স্থানীয় সরকারের সাথে চালায় যোগাযোগ। স্থানীয়ভাবে বাঙালিদের সংগঠিত শক্তি আর উদ্যোগকে পুঁজি করে ওল্ডহ্যাম কাউন্সিলে এ ইস্যুটি খুবই গুরুত্ব পায় এবং শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল ২৮ হাজার পাউন্ডের অনুদান প্রদান করে শহিদ মিনার নির্মাণের জন্যে। এমনকি মিনারের জন্যে জমিও বরাদ্দ দেয় স্থানীয় প্রশাসন অর্থাৎ ওল্ডহ্যাম কাউন্সিল। ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ এসোসিয়েশন,ওল্ডহ্যাম ইয়ুথ এসোসিয়েশনের পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী যুবলীগের একটা প্রধান ভূমিকা ছিলো এই শহিদ মিনার নির্মাণে। নিঃসন্দেহে এ ছিলো বাঙালিদের এক বিরাট অর্জন। এই প্রথম নির্মিত হয় বাংলাদেশের বাইরে ভাষার দাবিতে শহিদদের স্মরণে স্মৃতির স্থায়ী মিনার। ঢাকার শহিদ মিনারের আদলে নির্মিত এই শহিদ মিনারটি উদ্বোধন করা হয় ১৯৯৭ সনের ৫ অক্টোবর।

ভাষা ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক আলতাব আলী পার্ক শহিদ মিনার
ওল্ডহ্যামের জনগণের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে এর বছর তিনেক পরেই নির্মিত হয়েছে আরেকটি শহিদ মিনার। বর্ণবাদীদের হাতে নিহত আলতাব আলী পার্কে নির্মিত এই শহিদ মিনারে একুশের ঊষালগ্নে জমায়েত হয় হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আর অরাজনৈতিক মানুষের সাথে নতুন প্রজন্মের উপস্থিতি আলতাব আলী পার্ককে মহিমান্বিত করে। এই আলতাব আলী পার্ক বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে আছে ব্রিটেনের ইতিহাসে। শহিদ আলতাব আলী ব্রিটেনে অভিবাসী বাংলাদেশি ফ্যাক্টরি শ্রমিক ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ৪ মে কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে বর্ণবাদীদের হাতে খুন হন। সাথে সাথে ফুঁসে উঠে বাংলাদেশিরা। আন্দোলন সংগ্রামে যোগ দেয় অনান্য কমিউনিটির লোকজন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে কেঁপে উঠে পুরো ইষ্ট লন্ডন। সেই আন্দোলনের ফসলে ইষ্ট লন্ডন মুক্ত হয় বর্ণবাদীদের হাত থেকে। ১৯৯৮ সালে সেন্ট মেরিস পার্ককে আলতাব আলী পার্ক নামকরণ করা হয়।

১৯৯৯ সালে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের দক্ষিণ প্রান্তে একটি শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেটি বাঙালির ভাষা-শহিদদের স্মরণে বহির্বিশ্বের বানানো দ্বিতীয় শহিদ মিনার। তার আগে ব্রিটেনে বাঙালি কমিউনিটির সর্ববৃহৎ ও প্রাচীনতম সংগঠন বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনের সাড়ে বায়ান্ন হ্যানবারি স্ট্রিটের একটি হলে অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে এই শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করা হতো।

দীর্ঘ কয়েক বছর এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে খোলা আকাশের নিচে একটি শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠার জন্যে স্থানীয় কাউন্সিলের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে। ১৯৯৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে প্রথম অস্থায়ীভাবে একটি শহিদ মিনার স্থাপন করে আলতাব আলী পার্কে। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সঙ্গে এ বিষয়ে দেন-দরবারের এক পর্যায়ে একটি স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণে কাউন্সিল-কমিউনিটি ঐক্যমতে পৌঁছতে সক্ষম হয়। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে কমিউনিটিকে প্রস্তাব দেওয়া হয় জায়গা বরাদ্দ দেবে কাউন্সিল, কিন্তু শহিদ মিনার তৈরির খরচ বহন করতে হবে কমিউনিটিকে। এই প্রস্তাবে কমিউনিটির সম্মতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন শুরু করে ফান্ড সংগ্রহ তৎপরতা।
এ তৎপরতায় এগিয়ে আসে বাংলাদেশ হাইকমিশন, সোনালী ব্যাংক, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, জাসদ ও উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীসহ ৫৪টির মতো সংগঠন। আর এই ৫৪ সংগঠনের যৌথ অংশগ্রহণে গঠন করা হয় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার কমিটি। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আলতাব আলী পার্কে স্থায়ী শহিদমিনার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হলে কেন্দ্রীয় শহিদমিনার কমিটি এর ব্যয় নির্বাহে সম্মতি জানায়।

ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনসহ ৫৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে শহিদ মিনার নির্মাণের ব্যয় হিসেবে কাউন্সিলের কাছে তুলে দেওয়া হয় প্রায় ২২ হাজার পাউন্ড। এভাবেই আলতাব আলী পার্কে স্থায়ীভাবে নির্মিত হয় শহিদ মিনার। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী।

লুটনে স্থাপিত হয় তৃতীয় শহিদ মিনার
২০০৪ সালের ৮ আগস্ট লুটনে উদ্বোধন করা হয় ব্রিটেনের তৃতীয় শহিদ মিনার। লন্ডন থেকে লুটনের দূরত্ব ৪৬ কিলোমিটার। লুটনের ব্যারিপার্ক অঞ্চলেই অধিকাংশ বাংলাদেশি কমিউনিটির বসবাস। এই শহরটি বাংলাদেশি ঘনবসতির দিক থেকে চতুর্থ। সত্তরের দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদীদের কর্মকাণ্ড চরম আকার ধারণের সময় লুটনে বর্ণবাদী হামলা রুখে দিতে বাংলাদেশি কমিউনিটির তরুণদের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিলো বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ। বর্তমানে লুটনের লেন্ডগ্রিব রোডের যে স্থানে সিওয়াই সিডি সেন্টার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেখানেই ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ স্থাপিত হয়েছিলো। বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের ২৫ বছর পূর্তিকে স্মরণীয় করে রাখতে লুটনে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে সংগঠনটির উদ্যোক্তারা।

বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের তৎকালীন চেয়ারপারসন সাংবাদিক মারুফ আহমেদ বলেন, ইয়ুথ লীগের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই শহিদ মিনার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন কমিউনিটির লোকজন, ব্যবসায়ীরা এই উদ্যোগে সহায়তা করতে চাইলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সংগঠনের নিজস্ব ফান্ড দিয়ে শহিদ মিনারের কাজ সম্পন্ন করা। সংগঠনের নিজস্ব ভূমিতে শহিদ মিনার স্থাপন করতে প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড খরচ করা হয়। শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ হাই কমিশনের তৎকালীন হাই কমিশনার মোফাজ্জল করিম ও সাবেক লর্ড বিল ম্যাকেনজি। এছাড়া সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক ব্রিটিশ সংসদ সদস্য মার্গারেট মরান, কাউন্সিলার তাহির আলী, সাবেক কাউন্সিলার ও ডেপুটি মেয়র মৃত রমিজ আলী, বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের ট্রাষ্টি সামসুজ্জামান, আব্দুল হালিম, কাউন্সিলার ইরাক চৌধুরী, রোমেল খান, বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের কর্মী ফজিলত খানসহ আরও অনেকে।

বার্মিংহামের শহিদ মিনার স্থাপন করে মাল্টি পারপাস সোসাইটি
ব্রিটেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা বার্মিংহাম। বহির্বিশ্বে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা প্রথম উত্তোলিত করে ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়েছে বার্মিংহামের নাম। বার্মিংহামে একটি স্থায়ী শহিদ মিনার স্থাপন করতে বার্মিংহামের বাঙালিরা স্বাধীনতার পর সময় নিয়েছে চার দশক। বার্মিংহাম শহিদ মিনার কমিটির সভাপতি মো. গাবরু মিয়া বলেন, বার্মিংহামে একটি স্থায়ী শহিদ মিনার স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে এখানকার বাঙালিরা নানাভাবে চেষ্টা করে গেছে। এজন্য বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার মূলধারার রাজনীতিবিদদের নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন কমিউনিটির নেতৃবৃন্দ। এক পর্যায়ে স্থানীয় নির্বাচনে কাউন্সিলার পদপ্রার্থীদের নানাভাবে বোঝানো হয় যে, বাঙালিদের ভোট পেতে হলে একটি স্থায়ী শহিদ মিনার স্থাপনের ঘোষণা দিতে হবে। এক পর্যায়ে বাঙালি কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের অনুরোধে বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিলের তৎকালীন বিরোধী দলীয় লিডার অফ কাউন্সিল স্যার আলবার্ট বোরে ২০০৯ সালে স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের বিষয়ে বার্মিংহাম সিটি কাউন্সিলে এক সভার আহবান করেন। সেখানে উপস্থিত বাঙালি কমিউনিটির নেতৃবৃন্দসহ সকলের উপস্থিতিতে স্যার আলবার্ট বোরে সবাইকে প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি সিটি কাউন্সিলের মূল দায়িত্বে গেলে বাঙালিদের জন্য স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণ করে দেবেন। সেজন্য তিনি স্থান নির্ধারণের জন্য বাঙালি কমিউনিটির নেতৃবৃন্দকে দায়িত্বও প্রদান করেন।

বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নাসির আহমেদ বলেন, ২০০৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের বোর্ডের সভায় অন্যতম ডাইরেক্টর মো. গাবরু মিয়ার প্রস্তাবে মাল্টিপারপাস সেন্টারের অভ্যন্তরেই একটি স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বোর্ড সভায় উঠা এই প্রস্তাব অন্যান্য ডাইরেক্টর আলহাজ্ব ফয়জুর রহমান চৌধুরী এমবিই, আব্দুল লতীফ জেপি, আলহাজ্ব কামরুল হাসান চুনু, মিসেস মাহবুবা খান ও মিসেস শাহিদা বেগম চৌধুরী সমর্থন দিলেন। বার্মিংহাম বাংলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও রেডিও বাংলা বিভাগের প্রধান মোস্তফা চৌধুরী যুবরাজ বলেন, ২০১০ সালে চ্যানেল আই ইউরোপের একটি লাইভ শোতে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নাসির আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলেন পরের বছরই অর্থাৎ ২০১১ সালেই বার্মিংহামের বাঙালিরা একটি স্থায়ী শহিদ মিনার পাবে। স্থান নির্ধারণ নিয়ে বিতর্কে না গিয়ে বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের কর্তৃপক্ষ সিটি কাউন্সিলের সহায়তা ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

বার্মিংহাম বাংলাদেশি জাতীয় দিবস উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হাজী আব্দুল কাদির আবুল বলেন, ২০১১ সালে ৭ ফেব্রুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাত্র নয়দিনের মধ্যে ২০১১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মাল্টিপারপাস সেন্টারের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নাসির আহমেদের নেতৃত্বে সেন্টারের ডিরেক্টরবৃন্দ বাঙালি কমিউনিটির নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে উদ্বোধন করা হয় বার্মিংহামের বাঙালিদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন স্থায়ী শহিদ মিনার। ২০১১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে প্রথমবারের মতো শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বার্মিংহামের বাঙালিরা।

ইপ্সউইচে ব্রিটেনের পঞ্চম শহিদ মিনার
সাফোর্ক বাংলাদেশি সোসাইটি, ইপ্সউইচে বাংলাদেশি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে বছরব্যাপী নানা আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসও উদযাপন করে থাকেন। সেই সময় স্থানীয় বাংলাদেশিরা শহিদ মিনারের কাঠের প্রতিকৃতি বানিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারে ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছিলেন।

সাফোর্ক বাংলাদেশি সোসাইটি ইপ্সউইচে স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ২০১২ সালে। ভাষার প্রতি এমন শ্রদ্ধাবোধ ও বাঙালির আত্মত্যাগের কথা ইপ্সউইচের কাউন্সিলকে স্থায়ী শহিদ মিনার নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৫ সালে স্থানীয় কাউন্সিলের সম্পূর্ণ অর্থায়নে ইপ্সউইচের আলেকজান্দ্রা পার্কে শহিদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ২০১৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আলেকজান্দ্রা পার্কে উদ্বোধন হয় ব্রিটেনের পঞ্চম স্থায়ী শহিদ মিনার।

কার্ডিফ শহরে ষষ্ঠ শহিদ মিনার
ব্রিটেনের ওয়েলসের ঐতিহ্যবাহী কার্ডিফ শহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে শহিদ মিনার। ২০০৭ সালে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরের কমিউনিটির দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। দশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টার পর ২০১৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নে কার্ডিফের সিটি হলে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সহ বিশিষ্টজনের উপস্থিতিতে এক গালা ডিনার পার্টিতে প্রতিশ্রুতিদানকারীদের নামের তালিকা ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর ব্রিটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাজমুল কাওনাইন, কার্ডিফের লর্ড মেয়র ডায়ান রিস ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ ও বিশিষ্টজনদের উপস্থিতিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। স্থানীয় কাউন্সিলের নানাবিধ জটিলতাকে দীর্ঘদিন মোকাবেলা করে শহরের ঐতিহ্যবাহী গ্রেইঞ্জমোর পার্কে কার্ডিফ কাউন্টি কাউন্সিলের প্রদান করা নির্ধারিত জায়গায় বাঙালি জাতির অহংকার শহিদ মিনার আজ পুরাপুরি দৃশ্যমান।

জীবনের কঠিন বাস্তবতার বাইরেও প্রবাসী বাঙালিরা তাড়িত হয় দেশমাতৃকার টানে, জেগে উঠে একুশ। একুশ মানে বিদ্রোহ, একুশ মানে একটি প্রতিবাদী উচ্চারণ ’না’ কিংবা ’বিজয়’ এর শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হয়ে এই ব্রিটেনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একুশের মিনার।

আইএ/ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

Back to top button