পর্যটন

ঘুরে আসুন নীল জলের অপূর্ব নদী সিলেটের লালাখাল

শীতকাল যেন শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। স্কুল কলেজের ছুটি শেষ। নতুন বছরের নানান ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এর মাঝেই এবারের বছরটা কিন্তু মজার। সারা বছরই সরকারি ছুটিগুলো পড়েছে সাপ্তাহিক ছুটির সাথে মিলিয়ে। তাই বেরিয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে প্রতি মাসেই। কিন্তু কোথায় বেড়াবেন? বেড়ানোর লিস্টে রাখতে পারেন সিলেট। কিন্তু মাধবকুন্ড বা চা বাগান দেখতে নয়। দেখে আসুন সিলেটের অপরূপ সুন্দর নীল জলের নদী লালাখাল।

লালাখাল বেড়ানোর এখনই উপযুক্ত সময়। শীতের এই সময়টায় আপনি পাবেন চমৎকার নীল জলরাশি। বর্ষার স্রোত নেই এখন। তাই পানি শান্ত, স্বচ্ছ। একেবারে যেন নদীর তল দেখা যায় উপর থেকে। যারা সিলেট যান নি তারা ভাবতেও পারবেন না যে পানি এত স্বচ্ছ হতে পারে! বর্ষায় স্রোতের সময় পানির রং হারিয়ে যায়। এই সময় বোনাস হিসেবে দেখতে পাবেন হরেক রকম শীতের পাখি।

লালাখাল সিলেট শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। প্রকৃতিকে একান্তে অনুভব করার জন্য স্থানটি বেশ উপযোগী। পাহাড়ে ঘন সবুজ বন, নদী, চা-বাগান ও নানা জাতের বৃক্ষের সমাহার লালাখালজুড়ে। পানি আর প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া এখানকার মানুষের জীবনযাত্রাও আপনাকে দেবে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা। দেখতে পাবেন আদিবাসিদের জীবনযাত্রা। এলাকাটিতে এখনো সেভাবে পর্যটকদের সমাগম হয় নি। তাই প্রকৃতির রূপ এখনো অক্ষুণ্ণ আছে। রাতের লালাখাল আরেক অপার্থিব সৌন্দর্যের পসরা। পূর্ণিমার দিনক্ষণ দেখে যেতে পারেন। জ্যোৎস্না ধোয়া নদীর রূপ সারাজীবন মনে রাখার মত। আর যদি পূর্ণিমায় নাও যেতে পারেন তবুও লালাখাল হতাশ করবে না আপনাকে। অগুনতি তারারা স্বাগত জানাবে আপনাকে।

লালাখাল নদীতে অসংখ্য বাঁকের দেখা মেলে। প্রতিটি বাঁকই দেখার মতো সুন্দর। নদী থেকে দূরে পাহাড় দেখা যায়। দেখলে যতটা কাছে মনে হয়, আসলে তত কাছে না। পাহাড়গুলোকে দেখলে মনে হয়, কেউ যেন নিজ হাতে থরেথরে একের পর একটি করে সাজিয়ে রেখেছে। এখানে পাহাড়ের গায়ে মেঘ জমা হয়। একটু কাছ থেকে দেখা যায়, মেঘেরা দল বেঁধে পাহাড়ের গায়ে ঠেস লাগিয়ে থেমে থাকে। আবার কখনো দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যায়। কখনো মেঘ বেশি জমা হলে এখানে বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। নদী আর পাহাড় মেলবন্ধনে নদীর টলটলে স্রোতস্বিনী জল আর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারা, এ যেন প্রকৃতির এক মায়াময়ী রূপের বাহানা। নদীর জলে নৌকার ওপর বসে পাহাড় দেখার সৌর্ন্দযই আলাদা। দল বেঁধে এখানে এলে সুবিধা বেশি, কারণ নৌকা ভাড়াটা কমে যায়। ভ্রমণে আনন্দও উপভোগ করা যায় এবং সবাই মিলে হৈচৈ করে আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়।

লালাখালের নাম ‘খাল’ হলেও এটি আসলে একটি সারি নদীর অংশ। পানির নীল রঙ দেখে যে কারো মনে হতে পারে এর নাম লালাখাল কেন! নীলাখাল হতে পারত! স্থানীয়রাও নামের কারণ বলতে পারেন নি। পানির রঙ ও ব্যাখ্যাতীত কারণে অপুর্ব নীল। বাংলাদেশের নীলনদ যেন লালাখাল।

আরও পড়ুন: নৈসর্গিক পূণ্যভূমি ভুটানের ৭ টি দর্শনীয় স্থান

সড়কপথ, নৌপথ দুভাবেই যাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও নৌ ভ্রমণটা বেশি উপভোগ্য বলে এটাকেই বেছে নেয় অধিকাংশ পর্যটক। নৌপথে যেতে যেতে যেদিকে চোখ যায়, মুগ্ধতায় নেমে আসে মগ্নতা! নিশ্চিতভাবে কিছুক্ষণের জন্য আপনি কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে চলছেন। লালাখালে বেড়াতে পারেন নৌকা অথবা স্পীডবোটে। ভিন্ন দুই ধরণের আনন্দ পাবেন। স্বচ্ছ জলে সকালের প্রতিবিম্ব একরকম, বিকেলে আবার তার ভিন্ন রূপ। তবে যে কোন জায়গার বিকেলটা বেশি সুন্দর হয়। প্রকৃতির সম্পূর্ণ আনন্দ নিতে হলে সারা দিন নৌকায় বেরিয়ে রাতেও থাকতে পারেন নৌকায়। অথবা তাঁবু টানিয়ে ফায়ার ক্যাম্প করতে পারেন নদীর তীরে। লালাখালে থাকার তেমন সুবিধা নেই। নতুন একটি রিসোর্ট গড়ে উঠেছে মাত্র। সেখানেও রাত কাঁটাতে পারেন।

যাতায়াত
লালাখালে যেতে হলে সিলেটের শিশু পার্কের সামনে থেকে লেগুনা অথবা জাফলংয়ের বাসে চেপে সিলেট-তামাবিল সড়ক ধরে যেতে হবে সারিঘাট। সিলেট আর জাফলং মাঝামাঝি এ স্থানটির নাম সারিঘাট। আগেই বলা হয়েছে, যাওয়ার জন্য পথ দুটি সড়কপথ ও নৌপথ। সড়ক পথে যেতে চাইলে মাইক্রোবাস বা কার ভাড়া নিলে ভালো হয়। তা ছাড়া সিলেট শহর থেকে বাস, লেগুনায় সারিঘাট গিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিতে পারেন। নৌপথে যেতে চাইলে আগে সারিঘাট পর্যন্ত একই নিয়মে বাস, লেগুনায় গিয়ে নৌযান ভাড়া নিতে হবে। ফেরার পথে এখান থেকে বাসে কিংবা লেগুনায় আসতে পারবেন। রাত ৮টা নাগাদ যানবাহন পাওয়া যাবে।

আবাসন

লালাখালে একমাত্র আবাসন ব্যবস্থা নাজিমগড় রিসোর্ট। আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়া ভাল। নাহলে রিসোর্টে রুম নাও মিলতে পারে। তবে বেশিরভাগ মানুষই সিলেট শহরে থাকেন, সেখান থেকে দিনে দিনে বেড়িয়ে আসেন। সেক্ষেত্রে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরতি পথে রওনা দেয়া ভাল। কারণ সন্ধ্যার পর নৌকা পাওয়া যায় না।

খরচ
সিলেট শহর থেকে শুধু লালাখালের জন্য মাইক্রোর ভাড়া দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে হবে, গাড়ি নিলে ভাড়া এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। সারা দিনের প্ল্যান হলে ভোরে সিলেট থেকে রওনা দিতে হবে। তা ছাড়া বাস কিংবা লেগুনায় ৪০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে সারিঘাট যেতে পারবেন। সেখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া ৮০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা আর স্পিডবোটে যেতে চাইলে ভাড়া এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা হতে পারে। নৌযানে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে, ভাড়া একই।

যা অবশ্যই করবেন না-
১। দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন না,
২। সন্ধ্যার পর নির্জন এলাকায় একা একা ঘুরবেন ন্‌
৩। শিশুরা থাকলে পানিতে না নামতে দেয়াই ভাল,
৪। সিগারেটের প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট বা এ জাতীয় কোন বস্তু যেখানে সেখানে ফেলবেন না।
পরিশেষে, সৌন্দর্য মনকে বড় করে। তাই যত পারা যায় সৌন্দর্যের কাছে যাওয়া উচিৎ আমাদের সকলের। কিন্তু সেই সৌন্দর্য রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখুন। প্রকৃতির কাছে গিয়ে হইচই, জোরে গান বাজানো থেকে বিরত থাকুন। নিজেও উপভোগ করুন, অন্যকেও উপভোগ করতে দিন অপার নিরবতা।

এন এইচ, ২৪ অক্টোবর

Back to top button