ব্যবসা

আবারও মার খেল কোরবানির অর্থনীতি

জাহিদুর রহমান

ঢাকা, ২৬ জুলাই – করোনা মহামারিকালে আরেকটি ঈদ চলে গেল। স্বাস্থ্য সংকট আর অর্থনৈতিক দুরবস্থায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে আসায় এবার ঈদুল আজহার অর্থনীতি ছিল প্রায় স্থবির, যার প্রভাব পড়েছে কোরবানির বাজারে। ২০১৬ সালের পর এবার সবচেয়ে কম পশু কোরবানি হয়েছে। কোরবানিযোগ্য ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩টি পশু অবিক্রীত থেকে গেছে। বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারি-ব্যাপারিরা।

মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে চামড়া খাত, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ফ্রিজ, মসলা, পোশাক, পরিবহন, পর্যটনসহ সংশ্নিষ্ট অন্যান্য ব্যবসায়ও। বিশ্নেষকরা বলছেন, করোনাকালে প্রায় দুই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। যারা গরু কোরবানি দিতেন, এবার তারা খাসি দিয়েছেন। যিনি লাখ টাকার গরু কিনতেন, এবার তিনি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কোরবানি দিয়েছেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। কিন্তু কোরবানি হয়েছে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু। এবার ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পশু কোরবানি হয়েছে।

তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। তার পর থেকে ক্রমাগত বেড়ে ২০১৭ সালে এক কোটি চার লাখ, ২০১৮ সালে এক কোটি ছয় লাখ, ২০১৯ সালে এক কোটি ছয় লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ওই বছর কোরবানি কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি। চলতি বছর কমে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু কোরবানি হলো।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে খামারি ২০-৩০ শতাংশ এবং প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ব্যাপারি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ নেমে গেছে। সে কারণেই কোরবানির পশুর বড় একটা অংশ অবিক্রীত থেকে গেছে। এ প্রেক্ষাপটে দুধ, মাংস ও চামড়ায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের আর্থিক ও নীতিগত সহায়তার দরকার আছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা বেগম বলেন, গবাদি পশু বিক্রি গ্রামের অধিকাংশ মানুষের নগদ টাকার অন্যতম উৎস। কিন্তু এবার গ্রামীণ অর্থনীতি ধাক্কা খেল।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার) জিনাত হুদা বলেন, প্রতিবছর কোরবানির পশু থেকে গড়ে ৫০-৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো বেচাবিক্রি হয়। যদি বিক্রি কমে আসে, তাহলে তো অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বেই।

ঈদের কেনাবেচা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো হিসাব এখনও কোনো সংস্থা দিতে পারেনি। তবে মাংস ব্যবসায়ী এবং চামড়া খাতের বিভিন্ন সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, এবার ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হতে পারে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব রওনক মাহমুদ জানান, সরকার এখন পশু রপ্তানির ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছে। মাংস রপ্তানি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিশ্নেষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন, ঈদে গবাদি পশু ঠিকমতো বিক্রি না হলে তার প্রভাব সব ক্ষেত্রেই পড়ে। কোরবানির হাটের অধিকাংশ টাকা গ্রামে চলে যায়। এ টাকা থেকে তাদের জীবনমান পাল্টাতে পারে। কিন্তু খামারিরা লোকসানের মুখে পড়লে গ্রামীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খামারিদের জন্য সরকারের প্রণোদনা বাড়ানো দরকার।

এদিকে, মহামারির চক্করে এবার চামড়া ব্যবসায়ও সংকট কাটেনি। মাঠপর্যায়ে কোরবানির পশুর চামড়া পানির দামে বিক্রি হয়েছে। দেড় লাখ টাকার একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। গত কয়েক বছরের মতো এবারও কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়ায় প্রকৃত সুবিধাভোগীরা যেমন বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি লোকসানের মুখে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, বছরে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয় ট্যানারিগুলোতে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ চামড়া আসে ঈদুল আজহায়। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হয়। তিনি বলেন, এবার ট্যানারি স্থানান্তর ও করোনার প্রভাবে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা নতুন ঋণ পেলে তারা চামড়ার প্রকৃত সুবিধাভোগী থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে পারতেন। কিন্তু বাস্তবে ৬০ থেকে ৬৫ কোটি টাকার ওপর ঋণ পাওয়া যায় না। তাই তারা পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করতে পারেননি। এতে উভয় পক্ষই হয়েছে ক্ষতির শিকার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির ঈদে প্রায় হাজার কোটি টাকার ভোজ্যতেল কেনাবেচা বেশি হয়। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ও মরিচ বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গরম মসলা এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরাসহ অন্যান্য মসলা বিক্রি হয় অন্তত ১০০ কোটি টাকার। কিন্তু এবার মসলার বাজারে উত্তাপ ছিল না। রাজধানীর পাইকার ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগে যে দোকানি মসলা কিনতেন এক কেজি, তিনি এখন নিচ্ছেন আড়াইশ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম করে। কারণ, কেনাবেচা নেই। লকডাউনে বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় মসলার চাহিদাও কমে গেছে।

পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির পশু ছাড়াও তৈরি পোশাক, জুতা, রেফ্রিজারেটর, মোবাইল, আসবাবসহ অন্য অনেক পণ্যের বিক্রিও বাড়ে। কিন্তু এবার বিধিনিষেধের কারণে সবকিছু থেমে ছিল। শেষ ছয় দিন ব্যবসার সুযোগ মিললেও কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার মতো অর্থ পাননি ব্যবসায়ীরা।

সারাবছর প্রায় ২০ লাখ রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার (ডিপফ্রিজ) বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৬০-৬৫ শতাংশ রেফ্রিজারেটর বিক্রি হয় কোরবানির আগে। এ সময় ফ্রিজার বিক্রি হয় ৮০-৮৫ শতাংশ। কিন্তু করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় বছরে এসে কোরবানিতে রেফ্রিজারেটর ও ডিপফ্রিজের বিক্রি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে গেছে। তবে বাজার খুব ভালো না হলেও যা মিলছে, তাতেই সন্তুষ্ট দেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটন। দেশের ফ্রিজের বাজারের ৭০ শতাংশ হিস্যা তাদের। এদিকে, দেশীয় প্রতিষ্ঠান ভিশনের ব্যবসা প্রবৃদ্ধিতে থাকলেও বিক্রি আশানুরূপ হয়নি। গত বছরগুলোর তুলনায় বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস লিমিটেড।

বিক্রি কমায় এরই মধ্যে অনেক ফার্নিচারের প্রতিষ্ঠান উৎপাদনই কমিয়ে দিয়েছে। দোকান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান টিপু বলেন, বিগত দিনগুলোতে আমরা শতভাগ পুঁজির ৭০ ভাগ হারিয়েছি। ঈদের আগে ছয় দিনে ৩০ শতাংশ পণ্য বিক্রি করে শুধু কর্মচারীদের সামান্য কিছু ঈদের খরচ দিতে পেরেছি। ৫৪ লাখ ব্যবসায়ী ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় জড়িত। প্রণোদনা না দিলে এ ব্যবসা আর টিকতে পারবে না।

এদিকে, পর্যটন খাতে করোনাকালের এই ঈদে অন্তত ২৫০ থেকে ২৭০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদ বলেন, আমাদের ৪৫ লাখ কর্মী নিঃস্ব, তারা কঠিন ক্রান্তিকাল পার করছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিফলন আমরা এই ঈদেও দেখলাম। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আগের চেয়ে এবার কেনাকাটা অনেক কম হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় গড়ে ৫ শতাংশ কমে গেছে। প্রায় দুই কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। সরকার বেশ কিছু ভালো নীতি নিয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তখন অর্থনীতির দুরবস্থা কেটে যাবে।

সূত্র: সমকাল
এম ইউ/২৬ জুলাই ২০২১

Back to top button