ভক্তদের আকুতি শুনতে পাচ্ছে বিসিবি
ঢাকা, ১০ নভেম্বর – বিশ্বকাপের ভরাডুবিতে দর্শক, ভক্তরা যতই কান্নাকাটি করুক লাভ নেই- এমনই ধারণা ছিল। চোখ বুঁজে বসে থাকবে বিসিবি। অতীতে হয়েছেও তাই।
কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে দিলো স্বয়ং ক্রিকেট বোর্ড প্রধান। ভক্তদের আকুতি শুনতে পেয়েছেন কর্তারা। নিচ্ছেন নানা উদ্যোগ। যা আশার আলো জ্বালছে ভক্তদের হৃদয়ে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সবগুলো ম্যাচ হেরে শুন্য হাতে বাড়ি ফিরেছে বাংলাদেশ। অতীতেও বহুবার হেরেছেন তারা। তবে এবারের হার ছিল দৃষ্টিকটূ। যা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। এবার খেলোয়াড়দের শরীরি ভাষায় জেতার কোনো আকাঙ্খা ছিল না। ভাবটা এমন ছিল-‘আমি জিতব না, দেখি আমারে কেমনে জেতাস’। আর তাতেই ভক্তদের মন ভেঙেছে। হারের ধরণগুলো ছিল খেলার আগেই আত্মসমর্পণ করার মতো।
গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলো এসব নিয়ে সরব। যাচ্ছেতাই বলে বিসিবি এবং খেলোয়াড়দের আক্রমণ করছেন কেউ কেউ। বিসিবি সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বেজায় চটেছেন। তিনি সরাসরি প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন বর্তমান বোর্ডকে। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর থেকে শুরু করে চিত্রনায়ক রুবেল, সবাই সোচ্চার বিষয়টি নিয়ে। সরাসরি বর্তমান কোচিং স্টাফকে অযোগ্য বলে আক্রমণ করেছেন সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসানও খেলোয়াড়দের এ্যাপ্রোচ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ‘ইট মারিলে পাটকেল’ এর মতো খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকেও সমালোচনাকারীদের আয়নায় মুখ দেখার কথা বলা হয়েছে। মাঠের পারফরমেন্সকে কেউ কেউ তৃতীয় শ্রেণির, পাড়ার ক্রিকেট, বিশ্বকাপে খেলার যোগ্য নয়- এসব বলে সমালোচনা করছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বাংলাদেশিরাও হতাশ। নিজের দেশের হতশ্রী পারফরমেন্সে তাদেরও যে সম্মান গেছে প্রতিবেশী দেশের বন্ধুদের কাছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে।
তবে এবার অন্যবারের মতো চুপচাপ বসে নেই বিসিবি। ক্রিকেটাররা দেশে ফেরার পরপরই বিসিবি শুরু করে দিয়েছে কিছু কাজ। নির্বাচক হাবিবুল বাশার দুবাই থাকতেই বলেছেন, তাদের ভাবনায় এখন ২০২২ সালের বিশ্বকাপ, যা হবে অস্ট্রেলিয়ায়।
খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর খোলনলচে পাল্টে ফেলতে যাচ্ছে ক্রিকেট বোর্ড। বেশ সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে বিসিবি। সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন গেলো শনিবার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডন গেছেন। ঠিক তার আগের দিন তার বাসায় বৈঠক করেছেন সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ও বর্তমান ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবালের সঙ্গে। এরপর বোর্ডের শীর্ষ পরিচালক ও নির্বাচকদের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন তিনি। দলকে সঠিক পথে আনতে করণীয় কি জানতে চেয়েছেন বোর্ড প্রধান।
কথা উঠেছে ডমিঙ্গোকে নিয়েও। মাশরাফির অভিযোগ, দক্ষিণ আফ্রিকার অযোগ্য কোচদের এনে একটা রিহ্যাব সেন্টার বানানো হয়েছে। সে বিষয়েও বোর্ড অনেকটা ইতিবাচক। বিশ্বকাপে চরম ব্যর্থ জাতীয় দলের কোচ রাসেল ডমিঙ্গোকে রাখার ইচ্ছে বিসিবির নেই। তবে সমস্যা অন্যখানে- এই মুহূর্তে তাকে ছেড়ে দেওয়ার উপায় নেই। কারণ, আলোচিত এই বিশ্বকাপের ঠিক আগে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ পর্যন্ত তার সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছে বিসিবি। তাতে ৫০ শতাংশ বেতন বাড়িয়েও নিয়েছেন এই ব্যর্থ কোচ। আর ওই চুক্তিতে একটি ধারা আছে, চাইলেই বিসিবি তাকে ছাড়তে পারবে না। ছাড়তে পারবেন না ডমিঙ্গোও। যদি দুই পক্ষের কেউ চুক্তি ছাড়তে চান তাহলে এক বছরের পুরো বেতন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ডমিঙ্গোর মাসিক বেতন প্রায় ১৭ হাজার ডলার। এক বছরের বেতন দিয়ে ডমিঙ্গোকে ছাড়া মানেই পুরো লস। এজন্য বিকল্প ভাবনায় গিয়েছেন বিসিবি বস।
সম্প্রতি জাতীয় দলের জন্য টিম ডিরেক্টর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে খালেদ মাহমুদ সুজনকে। সহকারী কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে।
তবে আমার কাছে বেশি পজিটিভি মনে হয়েছে আরেকটি খবর। দুজন পুরোনো কোচকে ফেরানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বোর্ড। বাংলাদেশের ক্রিকেটের বাঁক বদলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে ও জেমি সিডন্সকে পেতে চায় বোর্ড। পরিকল্পনায় হাথুরু আছেন প্রধান কোচ এবং সিডন্স আছেন ব্যাটিং কোচ হিসেবে।
তবে ওই দুজনকে সহসাই পাওয়া হচ্ছে না। আগামী বছরের আগস্টের আগে নতুন কোনো দায়িত্ব নিতে পারবেন না হাথুরুসিংহে। আর সিডন্সকে পেতেও অপেক্ষা করতে হবে। জানা গেছে, হাইপ্রোফাইল দুই কোচের জন্য বিসিবি অপেক্ষা করতেও রাজি। তার আগ পর্যন্ত সুজন, সালাউদ্দিন এবং ডমিঙ্গোকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে চায় বোর্ড।
এদিকে আরেক খবরে বলা হয়েছে, খালেদ মাহমুদ সুজন টিম ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। মোহাম্মদ সালাউদ্দিন সিদ্ধান্ত জানাতে সময় চাইলেও তিনিও অনুশীলনে যোগ দিয়েছেন।
আছে আরও কিছু চমক। কয়েকজন তরুণ ক্রিকেটারকে অনুশীলনে ডেকেছে বিসিবি। তারা হলেন- নাজমুল হোসেন শান্ত, কামরুল ইসলাম রাব্বী, পারভেজ হোসেন ইমন, তৌহিদ হৃদয় ও তানভির ইসলাম। তাদেরকে পর্যাপ্ত সময়, স্বাধীনতা দিয়ে তৈরি করতে চান খালেদ মাহমুদ।
তবে আরও কিছু তরুণ ক্রিকেটরাকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা উচিত বলে আমি মনে করি। অনূধ্র্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী আকবর, জয়, স্পিনার রাকিব, তামিম জুনিয়র এদেরকেও ছায়া জাতীয় দলের অধীনে রেখে এখন থেকেই তৈরি করা উচিত। তৃণমূল থেকে বিগ হিটারদের খুঁজে বের করে আনা উচিত। কারণ, টি টুয়েন্টিতে বিগ হিটের কোনো বিকল্প নেই। সেদিক থেকে বর্তমান দলে বিগ হিটার কেউ নেই।
জানা গেছে, বিশ্বকাপে ভরাডুবির কারণ জানতে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে বিসিবি। সামনে পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজ। তাই হয়তো ততটা কঠোর হবে না বিসিবি। কিন্তু খেলোয়াড়দের কাছ থকে জানতে চাইবে- সমস্যাটা আসলে কি ছিল। এটাও ভালো দিক। কারণ, কমিটমেন্ট ধরে রাখার জন্য এ্যাকাউন্টিবিলিটি দরকারি বিষয়।
তবে সব ছাপিয়ে আমি আশাবাদী অন্য কারণে। বাংলাদেশে বহু কোচ এসেছেন। গর্ডন গ্রিনিজ, ডেভ হোয়াটমোর, রিচার্ড পাইবাস থেকে শুরু করে তালিকায় ছিলেন অনেকেই। তবে আমার পছন্দের শীর্ষে এখনো হাথুরু। কারণ একটাই- ফেয়ারলেস বা ভয়ডরহীন ক্রিকেট শিখিয়েছিলেন তিনিই। তার সময়ে বাংলাদেশ সফলতাও পেয়েছে। সেইসঙ্গে খেলতে নামার আগেই ভয় পাওয়ার পুরনো রোগ সেরে গিয়েছিল। আগে আমরা সম্মানজনক হারের কথা ভাবতাম। হাথুরুর সময় সমান তালে লড়াই করার কথা ভাবতাম। হাথুরু নেই, বাংলাদেশের সেই লড়াইয়ের মানসিকতাও হারিয়ে গেছে। এখন আমরা অপেক্ষা করি- অন্যরা যদি খারাপ করে তাহলে সুযোগ নেব! আর প্রেস মিটে দলের প্রতিনিধিরা বাজান হাস্যকর এক রেকর্ড- ‘যদি আমরা ভালো ক্রিকেট খেলি তাহলে আমরা জিতব’। ভালো ক্রিকেট খেলতে কেউ কি তাদের নিষেধ করেছেন?
যাহোক, সব মিলিয়ে বিসিবি’র সাম্প্রতিক উদ্যোগ আমার কাছে খুবই ইতিবাচক ঠেকছে। হয়তো সামনে আরও কিছু আশা জাগানিয়া পরিবর্তন দেখতে পাবে ক্রিকেট ভক্তরা। এতোসব খারাপের মধ্যে একটা ভালো খবরও আছে। আগামী বছরের বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই খেলতে হবে না, সরাসরি চূড়ান্তপর্বে খেলবে বাংলাদেশ। তার চূড়ান্ত প্রস্তুতিও দরকার।
সূত্র : রাইজিংবিডি
এন এইচ, ১০ নভেম্বর