সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনির মধ্যে ছিল গভীর প্রেম। ওদের চার বছরের প্রেম রূপ নিয়েছিল বিয়েতে। একসঙ্গে কাজ করতে করতেই গড়ে উঠেছিল প্রেমের সম্পর্ক। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক সম্মতিতেই। সাগরের পরিবারের ইচ্ছা ছিল সাগরকে তারা অনেক বড় ঘরে বিয়ে দেবেন। সুন্দরী বউ আনবেন। তাদের মনের মতো বউ হবে। কিন্তু সাগর তাতে রাজি ছিলেন না। জানিয়ে দিয়েছিলেন বিয়ে করলে রুনিকেই করবেন। এ কারণে সাগরের পরিবারকে ছেলের পছন্দকেই মেনে নিতে হয়েছে। সাগর ও রুনি’র ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ২০০২ সালের ২৪শে জুন তাদের বিয়ে হয়। ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমেই দুই পরিবারের সদস্যদের জানানো হয়। তারপর আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিয়ে হয়। ওদের বিয়ে হয়েছিল আনন্দ কমিউনিটি সেন্টারে। মিডিয়ার সফল জুটি ও সুখী জুটি হিসেবেও কেউ কেউ আখ্যা দিয়ে থাকে তাদের। রুনি খুব উৎসাহে সাগরকে নিয়ে বিয়ের বাজার করেছিলেন। সব জিনিস নিজেদের পছন্দ করে কেনার কারণে বিয়েতে ওদের কোন জিনিসের কমতি ছিল না। ছিল না কোন অপূর্ণতাও। রুনি চ্যানেল আইতে কাজ করায় ওই সময়ে ওর প্রায় সব সহকর্মীই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সবাই ওদের বিয়েতে আনন্দ করেছিল। বিয়েতে রুনি সবাইকে শাড়ি পরতে বলেছিলেন। এ জন্য পরেছিলও। রুনির এক সহকর্মী বলেন, আমরা একসঙ্গে চ্যানেল আইতে ছিলাম। ওদের বিয়েতে সবাই খুব মজা করেছিলাম। আমরা ওদের প্রতি এতটাই সহনশীল ছিলাম এজন্য সব সময় চাইতাম সাগরের ডে অফ যেহেতু রোববার এজন্য ওকেও রোববার ছুটি দিতে হতো। এছাড়াও বিয়ের পর চ্যানেল আই থেকেও ওকে ছুটি দেয়া হয়েছিল। বিয়ের পর ওরা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। ওরা বেড়াতে পছন্দ করতো। সবার সঙ্গে মিশতো।
সূত্র জানায়, সংবাদের ‘জলসা’ থেকেই ওদের পরিচয়। সেখানে নতুন লেখক হিসেবে তারা পেশা শুরু করেন। ওদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েক জন সংবাদে যোগ দেন। এক পর্যায়ে সাগর যোগ্যতার বলে দায়িত্ব পান জলসা সম্পাদনা করার। তখন রুনিও কাজ করতেন। ওই সময়ে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাগর ও রুনির ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বলেন, বিয়ের পর নবাবপুরে সাগরের বাসায়ই রুনি সংসার পেতে ছিলেন। তবে সেখানে তার বেশি দিন থাকা হয়নি। পারিবারিক নানা কলহ লেগে থাকতো। এ অবস্থায় রুনিকে নিয়ে সাগর একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানেই শুরু হয় রুনি আর সাগরের সংসার। তাদের সংসার খুব ভালই চলছিল। সাগরের জীবনে সবচেয়ে বেশি সুখের দিনটি আসে পাঁচ বছর আগে যেদিন তার সন্তান মেঘের জন্ম হয়। মেঘকে নিয়ে তাদের সুখের সংসার ছিল। তারা একে অপরের প্রতি ছিলেন বিশ্বস্ত। তাদের আলাদা সংসারের দিনগুলো ভালই চলছিল। এ সময়ে সাগর সিদ্ধান্ত নেন জার্মানিতে যাওয়ার। রেডিওতে চাকরি নিয়ে চলে যান। সাগর জার্মানিতে গেলেও রুনি একবছর দেশেই ছিলেন। কিনু্ত স্বামী ছাড়া এখানে একা একা থাকতে তার ভাল লাগছিল না। স্বামীর টানে ও ভালবাসার কারণে নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে পাড়ি জমান বিদেশে। সেখানে তাদের সময় ভালই কাটছিল। তবে খরচ বেশি হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা খারাপ সময় কাটে। সাগর চাকরি করতেন, রুনি লেখাপড়া করতো। খরচ ছিল বেশি। মেঘের খরচ জার্মান সরকারের পক্ষ থেকেই পেতেন। রুনি জার্মানিতে যাওয়ার আগে তার পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতো। জার্মানিতে যাওয়ার আগে চাকরি ছেড়ে যাওয়ার কারণে তার পক্ষে আর টাকা দেয়া সম্ভব ছিল না। তবে রুনির মাকে সাগর আশ্বস্ত করেছিল সে বিষয়টি দেখবে। রুনি কখনও সাগরের কাছে কোন টাকা-পয়সা চাইতো না। তার সংকোচ হতো। এ কারণে জার্মানিতে থাকলেও সে আমাকে চাপ দিতে পারতো না। রুনি সেখানে নতুন করে পেশাগত জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সাগর সিদ্ধান্ত নেন আর ওখানে থাকবেন না। দেশে ফিরে সাগর তার ক্যারিয়ার গড়ে নেন। ভাল চাকরি পান। মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলায় যোগ দেন। তবে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দিতে হলেও তিনি চেয়েছিলেন বিশেষ প্রতিনিধির পদ। চাকরি ক্ষেত্রে খাপ খাইয়ে নিতে এবং নতুন করে সংসার গোছানো, চাকরিতে ক্যারিয়ার গড়া সব মিলিয়ে ভীষণ চাপের মধ্যে পড়ে যান। সব দিক সামলাতে গিয়ে অনেকটা হাঁপিয়ে ওঠেন রুনি। তিনি তার কাছের মানুষদের বলেছেন, তিনি ভীষণ ক্লান্ত। আর কোন কিছুই ভাল লাগছে না। সব মিলিয়ে রুনি মানসিকভাবে অনেকটা আপসেট হয়ে পড়েন। এদিকে এ ধরনের সমস্যা হলেও রুনি তা স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করতেন না। রুনি’র প্রতি সাগর সব সময় ভীষণ কেয়ারিং ছিল। কিন্তু পরে অনেকটা ব্যস্ততার কারণে সাগর বেশি সময় কাজে ব্যস্ত থাকতেন। রুনির মনে হতো সাগর অনেক বদলে গেছে। আগে তাকে যেমন ভালবাসতো তেমন বাসে না। এ নিয়ে তিনি মন খারাপ করতেন। এর কারণও ছিল সাগর টেলিভিশনে যোগ দেয়ার পর তিনি এত বেশি সময় দেয়া শুরু করেন যে পরিবারে তেমন সময় দিতে পারতেন না। এমনকি বেশির ভাগ দিনই তার নাইট ডিউটি থাকতো। তার কাজের মান ভাল হওয়ায় ও তিনি কর্মঠ হওয়ার কারণে আর অফিস চাইতো মূল সংবাদগুলোর সময়ে সাগরই দায়িত্বে থাক। এ কারণে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব পালন করতে হতো। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে কিছুটা দূরত্বও তৈরি হয়েছিল। রুনির এক ঘনিষ্ঠ জন বলেন, রুনি প্রায় দুঃখ করতো আর বলতো- আমার কোন কিছু ভাল লাগে না। কি করবো বুঝতে পারছি না। শেষ দিকে রুনি ভীষণ হতাশায় ভুগতো। এটা অনেকেই দেখেছে। রুনির ঘনিষ্ঠ একজন বলেছেন, ওরা বিয়ের পর প্রায় ১০ বছর পার করেছে। ভালই দেখেছি ওদের। সংসারটা ভাল ছিল, সুখের ছিল। তবে সাগরের পরিবারের কয়েক জনের কারণে ওদের মধ্যে কিছুৃটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এনিয়ে রুনি অল্প-বিস্তর বলতো। তবে সব কথা বলতো না। খালি মন খারাপ করতো। তিনি বলেন, ওরা দু’জনই ভাল। তারপরও একটি বিষয় উড়িয়ে দিচ্ছি না। তা হচ্ছে রুনি আর সাগরের মাঝখানে অন্য কোন নারী রয়েছে কিনা তা-ও দেখতে হবে। কেন তাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলো- এ কি কেবল রুনির হতাশা আর সাগরের ব্যস্ততা নাকি অন্য কোন কারণ। সাগরের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলেছেন, রুনি আর সাগরের মধ্যে কিছুটা সমস্যা ছিল এটা বড় কোন ঘটনা নয়। কারণ, এমনটি সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই থাকে। রুনির ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, পারিবারিকভাবে ওদের মধ্যে ছোটখাটো সমস্যা ছাড়াও একটা সমস্যা ছিল তা হচ্ছে- রুনির ছোট ভাই একজন মাদকাসক্ত। তাকে নিয়ে রুনি খুব চিন্তা করতো। তাকে তার টাকা দিতে হতো। এছাড়া বড় ভাইয়ের একটা ভাল চাকরি ছিল না- এ নিয়ে খুব দুঃখ ছিল। সব সময় বলতো বড় ভাইকে একটা ভাল চাকরি দেয়ার কথা। রুনির বেতনের একটা বড় অংশ চলে যেতো তার পিতার পরিবারে। এটা মেনে নিতে পারতো না সাগরের পরিবার। এগুলো সাগর এড়িয়ে যেতেন। তবে মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ করতেন। রুনি ও সাগরের মধ্যে বছর খানেক ধরে কিছুটা খারাপ সম্পর্ক গেলেও এটা তারা বাইরে বুঝতে দিতো না। তাদের ঘনিষ্ঠ আরও একজন বলেছেন, সাগর ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে। পুরনো ঢাকায় তার সম্পত্তি রয়েছে। সে পরিবারের একমাত্র ছেলে। বোন আছে। ভাই নেই। সম্পত্তি নিয়ে কারও সঙ্গে বিরোধ থাকতে পারে। কারণ, বেশির ভাগ শত্রুতা তৈরি হয় সম্পত্তি ও টাকা-পয়সা নিয়ে। তার ধারণা ঘটনার দিন সাগর অফিস শেষে বাসায় ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করেছে। খুনিরা হয়তো পরিচিত। সাগরের সঙ্গে তাদের মধ্যে হয়তো কথাবার্তাও হয়েছে এবং এক পর্যায়ে বনিবনা না হওয়ার কারণে আক্রোশের বশে খুন করা হতে পারে। ওই বন্ধু বলেন, যারাই কাজটি করেছে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে করেছে। আনাড়ি হাতের কাজ নয়। কারণ, অপেশাদার লোকই যদি হবে তাহলে তারা জানালার গ্রিল কেমন করে কাটলো। গ্রিল কেমন করে কাটতে হয়, কাটলে শব্দ হবে না এটাও তাদের জানা ছিল। তারা জানালা কাটলো আশপাশের কেউ শব্দ পেলো না। এটা কি সম্ভব? জানালা কাটার পরিকল্পনা যে কেউ চাইলেই ঘরে ঢুকে করতে পারে না। এজন্য হয়তো তারা ওই বাসায়ও গেছে। তিনি আরও বলেন, সাগরের হাত-মুখ বেঁধেছে তাতে মনে হয়েছে একাধিক ব্যক্তি সেখানে ছিল। তার মুখ হাত বাঁধার জন্য সময় লেগেছে। সাগরকেই হয়তো খুন করতে চেয়েছিল, রুনি বাধা দেয়ায় তাকেও খুন করেছে। তিনি আরও বলেন, খুনিরা বাসায় ঢুকেছে কেউ দেখেনি। বেরিয়ে গেছে কেউ দেখেনি। এটা কি সম্ভব? এখানে রহস্য আছে। খুনিরা পরিচিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তারা যে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে এটা নিশ্চিত। তারা ওই বাসায় ভাত খেয়েছে। মেঘ তাদের দেখেছে। তাকে আবার দরজা বন্ধ করে রেখেছে। সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ হলে মেঘকে বাঁচিয়ে রাখতো না বলেই অনেকেই মনে করছেন। সূত্র জানায়, রুনি আর সাগরের মধ্যে এমন কোন ঘটনা আছে, যা কেউ জানে না। অথবা তাদের সঙ্গে এমন কারও বিরোধ আছে, যা অন্যরা জানে না। তারাও ওইভাবে কখনও কাউকে বলেনি। ওই ঘটনাটি বের করার দরকার। পুলিশ ওই ঘটনা বের করতে পারলেই বের হবে কারা খুন করেছে সাংবাদিক দম্পতিকে। কারা এ ঘটনার জন্য দায়ী। সাগর ও রুনির সহকর্মী ও বন্ধুরা বলেছেন, সবার আগে প্রয়োজন রহস্যের কিনারা করা। কি সে রহস্য, যা কি-না মেঘের মতো একটি শিশুকে এতিম করে দিতে পারে।