নরসিংদী, ২৮ এপ্রিল- মাত্র দুই শতাংশ জমির জন্য প্রাণ গেল দুই ভাইয়ের। নরসিংদীর মরজালে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে সালিশ বৈঠকে দুই সহোদরকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ। শনিবার রাত ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে তাদের মৃত্যু হয়। নিহত দুই সহোদর হালিম মিয়া ও জজমিয়া রায়পুরা উপজেলার মরজাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোক্তার হোসেনের ছোট ভাই। আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত গ্রামবাসী প্রতিপক্ষ সুরুজ আলীর বাড়িতে হামলা চালায় ও মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে রায়পুর ও নরসিংদী পুলিশ লাইন থেকে ৪ প্লাটুন পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এদিকে জোড়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের চাচা বাদী হয়ে রায়পুরা থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মরজাল ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি সুরুজ আলী ও তার দুই ছেলেসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলার আসামিরা হল- ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি সুরুজ আলী, তার ছেলে মাজেদুল ও সাইফুল। অপর আসামিরা হল- লিটন, খোকন, আরিফুল, রুবেল, আসাদ ও বাদল।
পুলিশ ও নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মরজাল বাসস্ট্যান্ডের সঙ্গে নিহত জজমিয়া ও হালিম মিয়াদের দুই শতাংশ জমি নিয়ে মরজাল ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি সুরুজ মিয়াদের দ্বন্দ্ব ছিল। এর জের ধরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও বিএনপি সমর্থিত দুই পরিবারের মধ্যে একাধিক মামলা-মোকদ্দমার হয়। এরই জের ধরে শনিবার দুপুরে দুই পক্ষের সার্ভেয়ার নিয়ে বিএনপি নেতা সুরুজ আলীর বাড়িতে সালিশ বসে। সালিশে জমি মাপাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতা সুরুজ আলীর ছেলে মাজেদুল ও সাইফুল জজমিয়া ও হালিম মিয়াকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে জজ মিয়া ও আবদুল হালিম মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লে আশপাশের লোকজন তাদের উদ্ধার করে প্রথমে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ও পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে জজমিয়া ও রাত ১১টার দিকে হালিম মিয়া মারা যায়। এ খবর এলাকাবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে প্রায় তিন শতাধিক লোক সংঘবদ্ধ হয়ে সুরুজ মিয়ার বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় উত্তেজিত গ্রামবাসী দুই সহোদরের খুনিদের গ্রেফতারের দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা চালায়। পরে রায়পুরা ও নরসিংদী পুলিশ লাইন থেকে ৪ প্লাটুন পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। অভিযুক্ত সুরুজ আলী ও তার দুই ছেলেসহ ৯ জনকে গ্রেফতারের পর গ্রামবাসী নিবৃত্ত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় ব্যাপক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
সরেজমিন নিহতের বাড়িতে ঘিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রবেশমুখে নিহতদের দাফন করার জন্য পাশাপাশি দুটি কবর খননের কাজ চলছে। বাড়িজুড়ে চলছে শোকের মাতম। নিহতদের স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনরা বিলাপ করে কান্না করছেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত নিহতদের বড় ভাই ও মরজাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোক্তার হোসেন শোকে যেন পাথর হয়ে আছেন।
নিহতের চাচা আনোয়ার হোসেন বলেন, মরজাল বাসস্ট্যান্ডের সঙ্গে ৯ শতাংশ জমির মধ্যে ২ শতাংশ জমি নিহতদের পৈতৃক সম্পত্তি। জমিটি বিএনপি নেতা সুরুজ আলীর জমির পাশে হওয়ায় দীর্ঘদিন তারা জমিটি দখল করে রাখে। জমিতে গেলেই প্রতিপক্ষ আমাদের হুমকি-ধামকিসহ মেরে ফেলার ভয় দেখাত। সর্বশেষ একটি মীমাংসার জন্য আমরা তাদের বাড়িতে বসেছি। কিন্তু বাড়িতে ডেকে নিয়ে যে খুন করবে এটা বুঝতে পারিনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার বাদী কালা মিয়া জানায়, দুই পক্ষের সার্ভেয়ার ও কমিশনের উপস্থিতিতে নকশার ভিত্তিতে জমি মাপার নির্দেশ দেয় আদালত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনার অ্যাডভোকেট মাসুদ ও উভয় পক্ষের সার্ভেয়ারদের উপস্থিতিতে জমি মাপতে গেলে সুরুজ আলীর পক্ষের সার্ভেয়ার অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান আদালতের নির্ধারিত জমি মাপ না দিয়ে পুরো এলাকার জমি মাপার কথা বলেন। এতে আপত্তি জানালে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতা সুরুজ আলীর দুই ছেলে ছুরি দিয়ে জজ মিয়া ও আবদুল হালিমকে বুকে-পিঠে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। এ সময় তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাতে তাদের মৃত্যু হয়।
মরজাল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নিহতের ভাই মোক্তার বলেন, হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত। একদিকে তারা আসামিদের বাড়িতে সালিশ বসিয়েছে অন্যদিকে আমাদের পক্ষের দুই ভাই ও চাচাকে ছাড়া অন্য কাউকে সালিশে থাকতে দেয়নি। আমি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।
রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহামুদুর রহমান জানিয়েছেন, বিএনপি নেতাসহ ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরও ৫-৭ জনকে আসামি করে নিহতের চাচা কালা মিয়া থানায় মামলা করেছেন।
নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ নেওয়াজ জানিয়েছেন, এজাহারনামীয় ১২ আসামির মধ্যে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।