“...হঠাৎ অনেক লোকের আনাগোনা, চেঁচামেচি কানে এলো। একজন বাংকারের মুখে উঁকি দিয়ে চিৎকার করলো, কই হ্যায়; ইধার আও। মনে হল আমরা সব একসঙ্গে কেঁদে উঠলাম। ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে অতংকগ্রস্থ করলো। কয়েকজনের মিলিত কন্ঠ, এবারে মা, আপনারা বাইরে আসুন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ...চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এত লোকের সামনে আমি সম্পুর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কন্ঠ প্রথমে আওয়াজ দিয়েছিলো, সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করলেন...আমি ওই শিখ অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম...আমাদের গায়ে ঘা, চামড়ায় গুড়িগুড়ি উকুন।...”
“...হঠাৎ অনেক লোকের আনাগোনা, চেঁচামেচি কানে এলো। একজন বাংকারের মুখে উঁকি দিয়ে চিৎকার করলো, কই হ্যায়; ইধার আও। মনে হল আমরা সব একসঙ্গে কেঁদে উঠলাম। ঐ ভাষাটা আমাদের নতুন করে অতংকগ্রস্থ করলো। কয়েকজনের মিলিত কন্ঠ, এবারে মা, আপনারা বাইরে আসুন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ...চিরকালের সাহসী আমি উঠলাম। কিন্তু এত লোকের সামনে আমি সম্পুর্ণ বিবস্ত্র, উলঙ্গ। দৌড়ে আবার বাংকারে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু যে বলিষ্ঠ কন্ঠ প্রথমে আওয়াজ দিয়েছিলো, সেই বিশাল পুরুষ আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে নিজের মাথার পাগড়িটা খুলে আমাকে যতটুকু সম্ভব আবৃত করলেন...আমি ওই শিখ অধিনায়ককে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম...আমাদের গায়ে ঘা, চামড়ায় গুড়িগুড়ি উকুন।...”
এ একজন নির্যাতিত নারীর অভিজ্ঞতা, ডঃ নিলীমা ইব্রাহিমের বেদনার আখ্যান “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” থেকে নেওয়া এক মর্মস্পর্শী কাহিনীর অংশবিশেষ। এমন হাজারো বাঙ্গালী নারীর নির্মম অভিজ্ঞতায় পুষ্ট আমাদের জাতীয় আত্মত্যাগের ইতিহাস। ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু তাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে বীরাঙ্গনা উপাধীতে ভূষিত করেছিলেন, দরাজ গলায় বলেছিলেন, “তোমরা তোমাদের বাবার নাম লিখে দাও শেখ মুজিব, আর ঠিকানা লিখে দাও ধানমন্ডি ৩২।” মহৎ হৃদয়ের বঙ্গবন্ধু তাদেরকে আপন করে নিতে পারলেও আমাদের সমাজ তাদেরকে আপন করে নেয়নি। এমনকি এদের অনেকের পরিবার, মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী, প্রেমিক পুরুষ, প্রিয় বন্ধু তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে ত্যাগ করেছে, মুছে দিয়েছে তাদের পরিচয়, ভুলে গিয়েছে তাদের অস্তিত্ব। “আমি বীরাঙ্গনা বলছি” গ্রন্থেই এর বহু প্রমাণ রয়েছে। শিক্ষিত ও আধুনিক চিন্তা-ভাবনার অধিকারী অনেকেই আজও, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে বীরাঙ্গনা ইস্যুতে হীনমন্যতার পরিচয় দেন। আমাদের সমাজের একটি বড় অংশের মন-মানসিকতার প্রভাবে এই শব্দটি কোন কোনো ক্ষেত্রে “ধর্ষিত”, “লজ্জিত” ইত্যাদির সমার্থক হয়ে গেছে যা কিনা মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের সার্বিক অবদানের স্বীকৃতিকে ম্লান করে দেয়।
আমাদের ধ্যান-ধারণার যাঁতাকলে পড়ে ৭১-এর নির্যাতিত নারীরা “বীর” পরিচয়ে সমাজে কখনও উপস্থাপিত হন নি এমনকি তারা নিজেরাও মাথা উঁচু করে সে গৌরবময় পরিচয় দিতে আসেননি কিংবা সংকোচের দেয়াল তুলে তাদেরকে আসতে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরেও এই মহিয়সী রমণীদেরকে প্রাপ্য সম্মান দিতে সেই পুরনো কুন্ঠা রয়ে গেছে। নির্যাতিতদের পরিবার থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদীপ্ত সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সবখানেই তাদেরকে নিয়ে এক ধরণের অস্বস্তি, যার জন্য নারীর “সম্মানের” তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক ধারণাটিই একক ভাবে দায়ী।
“বীরাঙ্গনা” শব্দটির আভিধানিক বিশ্লেষণ করাটা একটু প্রয়োজন। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ বীরাঙ্গনা অর্থ (১) বীর নারী, রণকুশলস্ত্রী (বিশেষ্য) (২) বীরপত্নী । অন্যদিকে ‘আকাদেমী বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান’-এ বীরাঙ্গনা অর্থ (১) বীরনারী, (বীর+অঙ্গনা), (২) বীরপত্নী। সুতরাং নারী নিজে যেমন বীর, তেমনি বীরের স্ত্রীও বীরাঙ্গনা। সামাজিক বা আমাদের চিরায়ত ভাবনার ফলশ্রুতিতেই নিশ্চয়ই আমরা পুরুষদের “বীর” আখ্যায়িত করতে আবশ্যিক ভাবে সাধারণত “বীর”-এর সাথে পুরুষ যুক্ত করে বীরপুরুষ বলি না। আবার “বীরপুরুষ” শব্দটিরও ব্যবহার রয়েছে, যা অস্বীকার করার কিছু নেই, তবে সাধারণভাবে “বীর” শব্দটি পু্রুষদের এখতিয়ারেই রয়ে গেছে বহুদিন ধরে, হয়ত মানব সভ্যতার শুরু থেকেই! তাই, নারীদের শুধু “বীর” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়নি, সাথে “নারী” বা “অঙ্গনা” শব্দটির বাহুল্য রয়েই গেছে ফলে একটা দ্ব্যার্থবোধক মানে কিন্তু রয়েই গেছে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে চরম ভাবে নির্যাতিত নারীদের বঙ্গবন্ধু “বীর” অর্থেই “বীরাঙ্গনা” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজ বীরাঙ্গনা শব্দটির দুর্বল অর্থটাকেই গ্রহণ করেছে, পরিচয় দিয়েছে চরম অসংবেদনশীলতার। সামগ্রিকভাবে নারীদের “সম্মানের” ধারণাটা এখনো আমাদের মনের অন্ধকার গন্ডি থেকে বের হয়ে আলোর মুখ দেখতে পায়নি। পুরুষে শৌর্য যেমন তার বীর্যের এবং বাহুবলের মধ্যে প্রোথিত করে রেখেছে এই সমাজ, তেমনি নারীদের সম্মানের বিষয়টিও তার যৌনাঙ্গ ঘিরেই এখনো আবর্তিত হয়! হতাশ হই যখন এখনো অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষের মুখে শুনি ‘নারীদের “সম্ভ্রমের/ ইজ্জতের/সম্মানের” বিনিময়ে’-জাতীয় কথা। নারীকে একটা নোংরা মানুষ (পশু বললে পশুদের অপমান হয়) কামড়ে, খুবলে রক্তাক্ত করলে, ধর্ষণ করলে নারীরই “ইজ্জত” যাবে- এ কেমন কথা! এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে দেশের অধিকাংশ “আধুনিক” মানুষের মুখে ডিসেম্বর বা মার্চ মাস আসলেই শোনা যায় ৩০ লক্ষ শহীদ এবং ২ লাখেরও অধিক মা-বোনের “ইজ্জত”-এর কথা! “ইজ্জত” শব্দের এই ব্যবহার তা সে জেনেই হোক বা না জেনেই হোক চরম অবমাননাকর ও অসংবেদনশীল।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন! সময় এসেছে ডিসকোর্স অ্যানালিসিস বা ভাব-ভাষা বিশ্লেষণ করার, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ভেঙ্গে নির্ভেজাল দৃষ্টিতে সব কিছুকে দেখার। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক অনাচার, বৈষম্য আর ভ্রষ্টাচারের মূল কারণ এই পুরুষতান্ত্রিক মনন, ভাষা ও সমাজ কাঠামো। এর মধ্যে বাস করে প্রগতিশীল জাতি গঠন ও উন্নয়ন এক অবাস্তব ধারণা। তাইতো এখনও আল্লামা শফীকে নারীদেরকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করতে শোনা যায়, মহিলা সংবাদকর্মীর উপর হামলে পড়তে দেখা যায় হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকার নাক-চোখ কামড়ে তুলে ফেলে পাষন্ড স্বামী।
কোনও একটা জায়গা থেকে আমাদেরকে শুরু করতে হবে। আসুন, আমাদের জাতীয় বীর- বীরাঙ্গনাদেরকে দিয়েই শুরু করি। একটা সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মত্যাগী, নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার সেইসব মহিয়সী নারীদের অবদানকে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য, আসুন সকলে আজ একটি শব্দ, একটি ধারণার পরিবর্তন আনি। ৩০ লক্ষ প্রাণের পাশাপাশি নারীদের ইজ্জত বা সম্ভ্রম নয়, বরং তাদের আত্মত্যাগের কথা উল্লেখের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথা দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে উচ্চারণ করি।