ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি- নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা নাটক-সিরিয়ালের পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে বাসায় ফিরেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। কিন্তু ঘরে ফিরেও বে-ঘরে হয়ে থাকতে হচ্ছে তাঁকে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো বিমুখ হয়ে আছেন, এরশাদের কাছাকাছি ভিড়ছেন না তাঁরা। বরং তাঁদের দৌড়াদৌড়ি এখন দলের সংসদীয় কমিটির নেতা ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের গুলশানের বাসার দিকে। যাঁরা রওশনের সাক্ষাৎ পাচ্ছেন তাঁরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছেন।
সূত্র জানায়, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও যাঁরা মন্ত্রিত্ব পাননি, দলের ওই সব নেতা আগামী দিনে কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা সরকারের কোনো করপোরেশন বা সংস্থার চেয়ারম্যান বা ভালো কোনো সরকারি দায়িত্ব পাওয়া যায় কি না, এর জন্য রওশনের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখনো দলের চেয়ারম্যান। কিন্তু তাঁর বাসা বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে নেতাদের তেমন ভিড় নেই। ভিড় যা আছে, তা কর্মীদের। বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ওয়ার্ড বা থানা পর্যায়ের নেতা ও কর্মীরা এখন এরশাদের পাশে। চেয়ারম্যানের কথায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে যাঁরা এমপি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরা ক্ষোভে তাঁর কাছে আসছেন না। রবিবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলেও গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত জাপার কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা হাই প্রোফাইল নেতা এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। শুধু দেখা করেছেন তাঁর ভাই জি এম কাদের ও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁরা এরশাদের একান্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। তাঁরা সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের বলেন, এরশাদ অসুস্থ ছিলেন না।
প্রেসিডেন্ট পার্কের কর্মচারীরা জানান, গতকাল ফাঁকাই ছিল প্রেসিডেন্ট পার্ক। দলের নেতাদের তেমন আনাগোনা ছিল না। এক কর্মচারী জানান, গতকাল সোমবার সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে ব্যক্তিগত কিছু কাজ সেরে আবার উপরে উঠে যান এরশাদ। সারা দিনে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাননি। তবে দুপুরের কিছু আগে মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ পারভেজ, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন ও সংসদ সদস্য সালমা ইসলাম এরশাদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলেন। খোঁজখবর নেন দলের নেতাদের। সে সময় সরকারের ‘আচরণে’ ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সালমা ইসলাম এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, “স্যার আমাকে বলেছেন, ‘কে বলেছে আমি অসুস্থ? আমি তো সুস্থই ছিলাম।” এরশাদকে চাপে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে সালমা বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।’ কিছুক্ষণ পর এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে আসেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা)। তিনি বলেন, এরশাদ আটক অবস্থায় ছিলেন। খালেদা জিয়াকে যেভাবে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল, একইভাবে এরশাদকেও হাসপাতালে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল।
এক মাস ধরে যাঁরা এরশাদকে সিএমএইচে চিকিৎসার নামে আটক করে রাখা হয়েছে বলে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন বাসায় ফেরার পর তাঁদের কেউ এরশাদকে দেখতে যাননি।
ইতিমধ্যে নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এমপি হয়ে শপথ নিয়েছেন দলের ৩৩ জন নেতা। বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছেন রওশন এরশাদ। জাতীয় পার্টি থেকে তিনজনকে মন্ত্রীও করা হয়েছে। দলীয় সূত্রের দাবি, এরশাদ তাঁর দল থেকে কাউকে মন্ত্রী না বানাতে সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা আমলে নেওয়া হয়নি।
এদিকে মন্ত্রিত্ব না পাওয়ায় দলের বেশ কয়েকজন এমপি ‘নাখোশ’। তাঁরা এ জন্য দলের চেয়ারম্যান এরশাদের ভূমিকাকে দায়ী করছেন। তাই দীর্ঘ এক মাস পর বাসায় ফিরলেও তাঁরা এরশাদকে দেখতে যাননি। এরশাদ তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ‘আটক’ থাকার সময় দলের সিনিয়র কোনো নেতা তাঁকে দেখতে যাননি। এখন বাসায় ফেরার পরও অনেক নেতা তাঁকে দেখতে যাচ্ছেন না।
জানা গেছে, রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় বাসায় ফেরার পর শুধু ভাই জি এম কাদের ও আরো দুই নেতা এরশাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। রাতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রেসিডেন্ট পার্কে ছুটে যান জি এম কাদের। তিনি এরশাদের সঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটান। সার্বিক খোঁজখবর নেন। এরশাদও কাদেরের কাছ থেকে দলের ভেতর-বাহিরের খবর নেন। জি এম কাদের দীর্ঘ এক মাস নির্বাচন ও সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে দলের নেতাদের ভূমিকা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে এরশাদকে অবহিত করেন। রাত ১১টা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পার্কে ছিলেন কাদের।
জাপার নতুন মুখপাত্র : সূত্র জানায়, দলের নেতাদের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ এরশাদ নিজের ও দলের মুখপাত্র পরিবর্তন করেছেন। গতকাল সোমবার বিকেলে পার্টির প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, মুখপাত্র হিসেবে প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের ও মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে দায়িত্ব দিয়েছেন এরশাদ। তাঁরা ছাড়া আর কেউ চেয়ারম্যানের বা দলের মুখপাত্র হিসেবে বিবৃতি বা বক্তব্য দিতে পারবেন না। এর আগে মুখপাত্রের দায়িত্বে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি ঢাকা-৬ আসন থেকে এমপি হয়েছেন। তিনি মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আশায় ছিলেন।