ঢাকা, ০৪ ডিসেম্বর- এই পৃথিবীতে অধিকাংশ স্বাভাবিক মানুষের ভীড়ে হঠাৎ করেই দুই-একজনের দেখা মেলে যারা অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা। ভাগ্যের ফেরে কিংবা কোন দুর্ঘটনায় হয়তো তারা হারিয়েছেন তাদের শরীরের কোন অমূল্য অঙ্গ। এদেরকে আগে বলা হত প্রতিবন্ধী, এখন বলা হয় ‘ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তি’।
কেন বলা হয় ভিন্নভাবে সক্ষম?
কারণ এই মানুষগুলো অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যান, থেমে থাকে না তাদের জীবনের গাড়ি। আর অনেকেই আছেন যারা তাদের প্রতিভা ও মেধার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন সমাজের নানা ক্ষেত্রে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের চারপাশ থেকে তারা খুব কমই সহযোগিতা পেয়ে থাকেন। আর বাংলাদেশের মতো দেশে এই ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের জীবন খুব সহজ নয় মোটেও। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই একই অবস্থা। প্রতিবন্ধী বা ভিন্নভাবে সক্ষম ব্যক্তিরাও যে মানুষ, তাদেরও যে অন্য দশ জন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই যে কোন ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে, এই বিষয়ে সবার সচেতনতা বাড়াতেই প্রতি বছর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ অন্যান্য দেশের সাথে বাংলাদেশেও পালিত হয় ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’।
আর গত ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের উদ্ভাবকেরাই জানালেন একটি সুখবর। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের চলাফেরায় সহযোগিতা করতে সক্ষম এরকম যন্ত্র তৈরির প্রচেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছে বিভিন্ন দেশে। তবে এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর অনেক গুলোই পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া সেগুলো বেশ ব্যয়বহুলও বটে। কিন্তু বাংলাদেশের তরুণ উদ্ভাবকেরা তৈরি করেছেন এরকম এক ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইস’ বা যন্ত্র,যা এদেশের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছে। আর এটা পাওয়া যাবে অনেক কম খরচে। এই দারুণ উদ্ভাবনের কৃতিত্বের দাবীদার সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল এবং চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রবি কর্মকার।
কিভাবে এই ইলেকট্রনিক ডিভাইস কাজ করবে?
উদ্ভাবকরাই জানান সে বিষয়ে। যন্ত্রটির ওজন খুব বেশি নয়। একারণে এটিকে খুব সহজেই হাতে বা শরীরের অন্য যে কোন সুবিধাজনক স্থানে লাগিয়ে ব্যবহার করা যাবে। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ৭৫ সেন্টিমিটার দূরত্বের মাঝে কোন বস্তু আসলেই এই ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা যন্ত্রে ভাইব্রেশন বা কম্পনের সৃষ্টি হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যতই সে বস্তুটির কাছে যাবেন কিংবা বস্তুটি তার কাছে আসবে, ততই এই ডিভাইসের ভাইব্রেশন বেড়ে যেতে থাকবে। আর এতে থাকবে দূরত্ব পরিবর্তনে সহায়তাকারী টিউনার,যার মাধ্যমে যন্ত্রটির কার্যপরিধি স্থান প্রয়োজন অনুসারে ১ সে মি থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এছাড়া এই ডিভাইসে শব্দের মাধ্যমেও এর ব্যবহারকারীকে সাহায্য করার সুবিধা রয়েছে। ব্যবহারকারী নিজের সুবিধামত Sound বা Vibration মোড এর যেকোন একটি বা উভয়টিই সিলেক্ট করতে পারবেন। উদ্ভাবকরা আরো জানান, এই যন্ত্রটি ছোট, সহজে বহনযোগ্য, হাত থেকে পড়ে গেলেও এটা নষ্ট হবে না। সবচেয়ে বড় কথা,খুব কম খরচেই এটা তৈরি করা যাবে। এক ঘণ্টা চার্জ দেয়া হলে এটা টানা ৫ দিন কাজ করতে সক্ষম। এতে রয়েছে সৌরশক্তিচালিত ব্যাটারি, এর মাধ্যমে কিংবা সাধারণ মোবাইল চার্জার দিয়েও এই ডিভাইসটি চার্জ দেয়া যাবে। আর তারবিহীন বা ওয়ারলেস চার্জিং এর ব্যবস্থা থাকায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা খুব সহজেই এই ডিভাইস ব্যবহার করতে পারবেন।
অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের তত্ত্বাবধানে ডিভাইসটি তৈরি করেন সৈয়দ রেজওয়ানুল হক নাবিল ও রবি কর্মকার। 'বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’ উপলক্ষে গতকাল দুপুরে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি দেশীয় প্রযুক্তির এই ইলেকট্রনিক ডিভাইসটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ইয়াসমিন হক। এই যন্ত্রটি তৈরিতে খরচ পড়বে মাত্র ১৭০০ টাকা। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এই যন্ত্রটির বাণিজ্যিক উৎপাদনে এগিয়ে আসার জন্য উদ্যোক্তাদের আহবান জানিয়েছেন।