গাজীপুর, ২০ জুলাই - দুধে আলতায় গায়ের রঙ, তুলতুলে মিষ্টি চেহারা। যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা রূপকথার দুই রাজকুমার। বড় রাজকুমারের নাম নিষাদ, ছোটজন নিনিত।
শুক্রবার (১৯ জুলাই) কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নুহাশ পল্লীতে গিয়ে তাদের দেখে বুকের ভেতর কষ্ট ছলকায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিলই হবে।
ঘুরে ফিরে নিষাদ-নিনিতকেই খুঁজছিল হুমায়ুন ভক্তদের চোখ। দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে ছোটজন, বড়জন আলাদা করা যায়। কিন্তু তাদের আলাদা দেখে অনেকেই বুঝতে পারছিলেন না- কোনজন নিষাদ, আর কোনজন নিনিত।
বাবার প্রয়াণ দিবসে শত শত মানুষের ভিড়, মা মেহের আফরোজ শাওনের সীমাহীন ব্যস্ততায় এতো লোক সমাগমেও যেন একা, নিঃসঙ্গ, ছন্নছাড়া এই দুই দুঃখী শিশু।
মিডিয়াকর্মীদের অনুরোধে বারবার ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসা হয় তাদের। পোজ দিতে দিতে এক সময় বাঁধ ভাঙে ধৈর্যের। কাঁদতে শুরু করে বিরক্ত নিনিত। রাগ করে নিষাদও।
সাংবাদিকদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত শাওনও ঠিকমতো ছেলেদের যত্ন-আত্মির সুযোগ পাচ্ছিলেন না। নিনিত বারবার কোলে চড়তে চায় মায়ের, ‘কোয়ে নাও, কোয়ে নাও।’
কচি কণ্ঠের এমন আবদারে হু হু করে বুকের ভেতর। কিন্তু তাদের কোলে নেওয়ার ফুরসৎই পাচ্ছিলেন না ব্যস্ত শোকাকুল শাওন। নিষাদ-নিনিতের নানী তহুরা আলীও যেন কিছুটা ব্যস্ত ও আনমনা, নাতিদের আব্দার পূরণের ফুরসতই মিলছিলো না।
খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিনিতের হঠাৎ খেয়াল হয়, জুতা পরা দরকার। অনেকবার জুতা চাইলেও তাকে জুতা পরিয়ে দেওয়ার সুযোগ কারও হলো না।
পায়ে মাটি লেগে যাবে বলে নিষাদও বারবার কোলে চড়তে চায় মায়ের।
আত্মীয় ও পরিচিতদের অনেকেই মিডিয়ায় প্রচারিত নুহাশ পল্লীর খবর দেখছিলেন টেলিভিশনে। নিষাদ-নিনিতের প্রতি সেভাবে লক্ষ্য করার মানুষ তেমন কেউ ছিল না।
কিছুক্ষণ পরপর মায়ের কোলে চড়ার আব্দার জুড়ছিলো দুই ভাই।
তহুরা আলী হেসে বলেন, মানুষজন দেখলে তাদের কোলে চড়ার আব্দার বেড়ে যায়। শাওন অসুস্থ, কীভাবে কোলে নেবে? তাকে (শাওন) স্যালাইন খাওয়াচ্ছি, দেখলেনই তো।
নিনিত দীর্ঘক্ষণ ধরে ‘পিনি (পানি) খাব, পিনি খাব’ বলে কান্নাকাটি করলেও তাকে পানি দিতে ছুটে আসার লোকও দেখা গেলো না।
নুহাশ পল্লীতে আসা হুমায়ুনের নারী ভক্তরা নিষাদ-নিনিতের কষ্ট বেশি অনুভব করছিলেন, নিজেদের মধ্যে বলাবলিও করছিলেন। পিতা হারানো দুই শিশুর দুঃখ সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।
‘ভূতবিলাস’ নামের বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে এক পরিবারের তিন সদস্য কিছুক্ষণ শাওন ও তার মা তহুরা আলীর সমালোচনা করতেও ছাড়লেন না।
হুমায়ুনের ভালোবাসায় অন্ধ এই ভক্তরা বলছিলেন, বাবা না থাকাতে মায়ের যত্ন থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে নিষাদ-নিনিত। নানীও তেমন মনোযোগ দিচ্ছেন না।
অপেক্ষাকৃত কমবয়সী সদস্যটি সবচে ক্ষুব্ধ। মাঝবয়সীকে প্রশ্ন করেন, শাওনকে একবারও বাচ্চা কোলে নিতে দেখেছো?
উত্তরে মাঝবয়সী বলেন, দেখেছি, যখন ক্যামেরা সামনে থাকে, কেউ কোলে নিতে অনুরোধ করে… তখন।
শাওন অবশ্য নিজেই ছেলেদের কষ্টের বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন।
তিনি বলেন, টানা তিনদিন ধরে এখানে আছি। আমার সঙ্গে আমার ছেলেরাও খুব কষ্টে আছে। তাদের যত্ন নেওয়ার সুযোগও পাচ্ছি না ঠিকমতো।
শাওন বলেন, যখন থেকে নিষাদ স্কুলে যেতে শুরু করেছে, তখন থেকে কিছুটা ভালো আছে। এখনো সবকিছু গুছিয়ে আনা সম্ভব হয়নি, তবে এক সময় হয়তো সব ঠিক হবে। হুমায়ুনের মতো শক্তিতো শাওনের নেই, তার মতো করে সব তো করতে পারি না।
হুমায়ুনের কাছের মানুষদের কাছ থেকে জানা যায়, জীবনের শেষ সময়গুলোতে নিষাদ-নিনিতের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহুর্ত কাটাতেন তিনি। সে সময়গুলোতে বেঁচে থাকার আকুলতা প্রকাশ করতেন হুমায়ুন।
অনেক আলোকচিত্রে হুমায়ুনের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ভঙ্গিতে তার ছেলেদের ছবি দেখে অনেকেই কেঁদেছেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৯ জুলাই বরেণ্য লেখক হুমায়ুন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ম্যানহাটন বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালটির ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ছিলেন তিনি।
হুমায়ুনের নিজ হাতে গড়া নুহাশ পল্লীর লিচু বাগানে তার দেহ সমাধিস্থ করা হয়।
বরেণ্য এই লেখকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জে নানা বাড়িতে।