বিদায় বেলা চোখের জল ধরে রাখতে পারছিল না আট বছরের মাহিয়া। সহপাঠী আর পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে যেতে তার মন চাইছিল না। তাই দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্চন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অনেকটা কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। কারণ সে হয়তো আর কখনোই কোরিয়ার মাটিতে ফিরবে না; কখনো দেখা পাবে না খেলার বন্ধুদের।
বাংলাদেশ থেকে কাজের সন্ধানে কোরিয়ায় যাওয়া অভিবাসী শ্রমিক দম্পতির ঘরে জন্ম মাহিয়ার। স্বাভাবিকভাবেই দেখতে সে মোটেও কোরিয়ানদের মতো নয়। ২০০৫ সালে রাজধানী সিউলের একটি হাসপাতালে তার জন্ম। দীর্ঘদিন বসবাসের পরও দক্ষিণ কোরিয়া সরকার তাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই দেশে ফিরতে হচ্ছে তাদের।
মাহিয়ার মূলত কোনো দেশ নেই। জন্ম কোরিয়ায় হলেও দেশটিতে তার জন্মনিবন্ধন হয়নি। একই সঙ্গে বাংলাদেশে তার জন্মনিবন্ধন না থাকায় সে বাংলাদেশেরও নাগরিক নয়। কোরিয়ার নাগরিকদের মতো দেখতে না হলেও মাহিয়ার আচরণ কোরিয়ার শিশুদের মতোই। সে বাংলা জানলেও কোরিয়ান ভাষায় সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। অভ্যস্ত হয়েছে কোরিয়ান খাবারেও। তাই ফেরার প্রসঙ্গে মাহিয়া সচরাচর বলে আসছে, ‘আমি ফিরে যেতে চাই না।’ তাকে ফিরতে হচ্ছে মা আলেয়ার সঙ্গে। তবে বাবা ফিলিপ থাকছেন কোরিয়াতেই।
আলেয়া জানান, মাহিয়ার বাবা কোরিয়াতে থাকছেন। তিনি নিয়মিত মাহিয়ার জন্য কোরিয়ান বই ও খাবার পাঠাবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার গায়ঞ্জি প্রদেশের নামিয়াঞ্জু এলাকায় মাহিয়ার পরিবার বাস করে। সেখানে মাসিওক এলিমেন্টারি স্কুলে লেখাপড়া করত সে। মাহিয়ার স্কুলের বন্ধুরা তাকে কোরিয়ান বলেই মনে করত। বিদায় বেলায় তাই তারাও বিষন্ন। তারা বলেছে, ‘আমরা তোমাকে ই-মেইল করব।’
কোরিয়ায় বসবাসের জন্য মাহিয়ার বাবা-মায়ের বৈধ কাগজপত্র ছিল না। এটাই মাহিয়ার জন্য কাল হয়েছে। তার মা ও বাবা দু’জনই ফার্নিচার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মাহিয়ার ছোট বোনের নাম অনপি। দুই বোনের দেখভালের জন্য চাকরি ছাড়েন তাদের মা আলেয়া। এবার মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেশ ছাড়লেন তিনি।
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া কোরিয়ায় বাস করা যাবে না দেশটির সরকারের এ ধরনের একটি কঠিন আইন রয়েছে। এ আইনের বলি হয়ে অনেক বাংলাদেশিকে ফিরে আসতে হয়েছে দেশে। এক সময় পর্যটক ভিসায় কোরিয়ায় গিয়েছিলেন মাহিয়ার বাবা-মা। তাদের সঙ্গে আরো অনেকেই যান। তারা দেখেছেন, কোরিয়া সরকারের কঠোর নীতির কারণে কিভাবে ওই বাংলাদেশিরা দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন।
চঞ্চল মেয়ে মাহিয়া পড়ত গণিত বিষয়ে। ক্লাসে পড়ালেখায়ও সে ছিল বেশ ভালো। পড়ালেখার প্রতি তার আগ্রহ বাবা-মাকে বিস্মিত করত। কখনো ক্লাস মিস করত না। জন্মস্থান ছেড়ে নতুন পরিবেশে এবার কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবে সে? কিংবা কোরিয়ায় জন্মের পর যে আট বছর সে কাটিয়ে এসেছে, তা কি তার শিশু মনে কষ্ট জাগাবে?
জাতিসংঘের শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী (ধারা ৭), জন্মের পর প্রত্যেক শিশুর নিবন্ধন করা উচিত এবং আইনগতভাবে তারা ওই দেশের নাগরিকে পরিণত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া সেই আইনের অনুসমর্থন করে। তথাপি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কোরিয়ায় মাহিয়ার মতো আরো অনেক শিশু বিতাড়ন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। তাদের কোরিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সূত্র : দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রকাশিত দ্য হ্যানকিওরেহ অনলাইন।