গত ৬ই ডিসেম্বর আমেরিকা জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তেল আবীব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করেছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ফিলিস্তিনে এ পর্যন্ত ১২ জনের বেশি বিক্ষোভকারী ইস্রাইলী সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।
গত কয়েক শুক্রবার জুমার নামাজের পর খোদ জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ থেকে মুসল্লীরা জেরুজালেম শহরে বিক্ষোভ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগ, ওআইসি, এমনকি মার্কিন পরম মিত্র বৃটেন- কেউই ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের প্রতি একমত পোষণ করেনি। তবে দুঃখের বিষয় সৌদি আরব ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ট্রাম্প ও ইস্রাইলকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে।
ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইস্রাইলের রাজধানী ঘোষণার আগে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে রিয়াদ ডেকে নিয়েছিলেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তখন আব্বাসকে বলেছিলেন আপনারা জেরুজালেম পাবেন না। জেরুজালেম হবে ইস্রাইলের রাজধানী। পূর্বজেরুজালেমকে আপনাদের রাজধানী করার দাবী প্রত্যাহার করে নিন। আপনাদের রাজধানী আবুদিস শহর। অসলো চুক্তি অনুসারে আবুদিস শহরটি দ্বিতীয় পর্যায়ের শহর এবং ফিলিস্তিন আর ইস্রাইলের যৌথ নিয়ন্ত্রণ কায়েম রয়েছে এ শহরে।
নিউইয়র্ক টাইমস্ তখন এ সংবাদ পরিবেশন করে বলেছিলো সৌদি যুবরাজ নাকি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্টকে দুইমাস সময় দিয়েছিলেন। ১০ ডিসেম্বর তুরস্কের ওআইসির সম্মেলনের পরে মাহামুদ আব্বাস ঘোষণা করেছেন জেরুজালেমকে ইস্রাইলের রাজধানী ঘোষণা করে আমেরিকা ইস্রাইল ফিলিস্তিনের বিষয়ে মধ্যস্থতা করার অধিকার হারিয়েছেন। এখন থেকে ফিলিস্তিন আমেরিকাকে আর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মানবে না।
এই ঘোষণার পর পুনরায় সৌদি বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ এবং যুবরাজ মহাম্মদ বিন সালমান ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ডেকে নিয়েছেন এবং বুঝানোর চেষ্টা করছেন আমেরিকা ছাড়া বিশ্বের কোনও শক্তির কথাই ইস্রাইল শুনবে না। সুতরাং আমেরিকাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে না মানার যে কথা বলেছেন তা প্রত্যাহার করে নিন।
অথচ হোয়াইট হাউসে বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছেন, বিদায় ফিলিস্তিন, বিদায় দ্বি-রাষ্ট্রীক সমাধান, বিদায় ফিলিস্তিনের জনগণ। ট্রাম্প বলেছেন, এ কথা বলছি কারণ জেরুজালেম তাদের জন্য।
উপরে যে কথাগুলো ট্রাম্প বলেছেন তারপর আমেরিকাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেতো আর মানা যায় না, অন্তত হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতদিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অবস্থান করছেন।
ইহুদীরা কেনান থেকে রোমান কর্তৃক বিতাড়িত হয়েছিলো ১৩৫ খৃষ্টাব্দে। তারপর রাষ্ট্রছাড়া যাযাবরের মতো ঘুরে ঘুরে থেকেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে- শতাব্দীর পর শতাব্দী। ইহুদীদেরকে প্রথম স্থায়ীভাবে বসতি গড়ার অনুমতি দিয়েছিলো আল আন্দালুসের শাসকেরা। আল আন্দালুস হচ্ছে স্পেনের মুসলমান শাসক কর্তৃক প্রদত্ত নাম। আল আন্দালুসে মুসলমান, খৃষ্টান আর ইহুদীরা একসঙ্গে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করেছিলো পাঁচশত বছর। ইতিহাস বলে ইহুদীরা আল আন্দালুসে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক রেনেসা ভোগ করেছে আর ইউরোপের অন্যান্য অংশে যারা ছিলো তারা নির্যাতন ও হত্যালীলার স্বীকার হয়েছিলো।
আন্দালুস যখন মুসলমানদের হাতছাড়া হয়েছিলো আর স্পেনের ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা যখন ধর্মান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলো তখন ৭০ হাজার ইহুদী খৃষ্টান হয়ে যায় আর দেড় লক্ষ ইহুদী অটোম্যান সম্রাজ্যের আশ্রয় নেয়। পর্তুগালে চলে যায় সত্তর হাজার। অটোম্যান সম্রাজ্যেও ইহুদীরা সুখে শান্তিতে বসবাস করেছে।
পর্তুগাল থেকে যারা পরে জার্মানীতে চলে যায় তারাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (৬০ লক্ষ) হত্যার শিকার হয়। ১৯৪৮ সালে ১৮১৩ বছর পর ইহুদীরা ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সারাবিশ্বে ইহুদীরা সংখ্যায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ আর মুসলমানের সংখ্যা একশত পঞ্চাশ কোটি। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সঙ্গে ইস্রাইল যে হটকারিতা করছে ইহুদিরা তার জবাব এ শতাব্দীর মধ্যভাগেই পাবে।
কিসিঞ্জার ইহুদিদেরই সন্তান। কিসিঞ্জার বলেছেন ইহুদিরা যদি মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমানদের সঙ্গে মিলিমিশে থাকার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী না হয় তবে এ রাষ্ট্রটি এ শতাব্দীর পাঁচ ছয় দশকের মাঝে বিলুপ্ত হবে। এখন আমেরিকার অবস্থা আর ভাল যাচ্ছে না। আমেরিকার একটা শিশু জন্মগ্রহণ করছে ৩০ মিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। সব ব্যবসাই এখন আটলান্টিকের উপকূল থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে চলে এসেছে। অস্ত্রের ব্যবসায় এখন রাশিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া আমেরিকার প্রতিযোগী।
ক্ষুদ্র এক উত্তর কোরিয়ার মত দেশকে কোনভাবেই সামাল দিতে পারছে না ট্রাম্প। পেন্ডুলামের মত এপাশ ওপাশ দোলা খাচ্ছে। বিশ্ব ব্যবস্থা স্থাপনে আমেরিকার যে কর্তৃত্ব ছিলো তা দুর্বল হয়ে গেছে। সম্ভবতো ট্রাম্পের সময় তা পরিপূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী সিআইএ গোয়েন্দার কাজ করতো তাদের কাজেও চুড়ান্ত ভাটার টান। সিআইএ’র ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিখ্যাত সাংবাদিক টিম ওয়েইনার বলেছেন দড়িকে সাপ বলে আর চুনকে দই বলে বহু অঘটন, ঘটিয়েছে এই সিআইএ। এখন সর্বস্তরে বিশ্বস্থতা হারিয়ে অথর্ব হয়ে বসে আছে। ন্যাটো দুই পয়সার বিশ্বাস করে না সিআইএ’র কোনও রিপোর্ট। ন্যাটো তার নাম দিয়েছে “ক্যান্ট আইডিনটিফাই এনিথিং” (সিআইএ)।
আমেরিকার দম্ভে বিশ্বের শান্তি নষ্ট হয়েছে বার বার। এখন দম্ভে ভয় পাচ্ছে না বিশ্বের অনেক দেশ। ইস্রাইলের মুল খুঁটিতো আমেরিকা। আমেরিকা তার পাশ্বে এক মাস অবস্থান না করলে এক হিজবুল্ল্যাহই তার অস্থিত্ব বিপন্ন করে ফেলবে। সম্ভবতো এ জন্যই কিসিঞ্জার বলেছেন যে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের সঙ্গে মিলে মিশে না থাকলে ইস্রাইলের অস্তিত্ব এ শতাব্দীর পাঁচ-ছয় দশকে বিপন্ন হবে। ১৯৭৩ সালে আরব ইস্রাইল যে যুদ্ধ হয় সে যুদ্ধে আমেরিকার কেনেডী বিমান বন্দর থেকে ইস্রাইলের তেল আবিব বিমান বন্দর পর্যন্ত অস্ত্রবাহী বিমানের সেতু সৃষ্টি না হলে ৭৩ সালেই ইস্রাইল বিপন্ন হয়ে যেত।
আরও পড়ুন: অন্ধকার শেষে সূর্যোদয় দেখতে চায় মানুষ
এখন আমেরিকা মিশরের সৈন্যদের কিছু বেতনের টাকা আর ইস্রাইলী সৈন্যদের বেতনের টাকা দেয়। এক সময় পাকিস্তানকেও দিতো। এখন আমেরিকার গ্রামীণ মানুষের মাঝে অভাবের হাহাকার। হয়তো কিছুদিনের মাঝে আমেরিকাকে এ বিলাসীতা বন্ধ করতে হবে। আমেরিকার সব সম্পদ এক শতাংশ মানুষের হাতে এসে পুঞ্জিভূত হয়েছে। গ্রামীণ মানুষ গরীব থেকে গরীবতর হচ্ছে। গরীব মানুষের হাহাকার বন্ধ করতে আমেরিকা হিমশিম খাবে ইস্রাইলকে পোষার সময় শেষ হয়ে আসছে আমেরিকার। সুতরাং ইস্রাইলীদের হটকারীতার জবাব পাওয়ার সময়ও দ্রুত এগিয়ে আসছে।
সৌদি বাদশা সালমান একদিকে ঘোষণা দিচ্ছেন ২০১৮ সাল থেকে তারা পূর্বজেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী করতে তৎপর হবেন। অন্যদিকে তারা ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বলছেন জেরুজালেমকে ইস্রাইরের রাজধানী হিসেবে মেনে নিতে আর সর্বশেষ আমেরিকাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে না মানার ঘোষণা দেওয়ার পর মাহামুদ আব্বাসকে বলছেন ঘোষণা প্রত্যাহার করতে। সৌদির এই দ্বিচারিতা মোনাফেকির লক্ষণ ওআইসি এই বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে সৌদি আরবের ভূমিকায় নিন্দা জানানো উচিৎ। মুসলিম জগতে অনৈক্য সৃষ্টির মূল হোতা হচ্ছে সৌদি আরব। ওআইসির উচিৎ মুসলিম বিশ্বের অসংলগ্ন আচরণের রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করা।
লেখক: শিক্ষক ও সাংবাদিক
এমএ/১২:২০/০৩ জানুয়ারি