জাতীয়

নতুনের কাছে নতুন প্রত্যাশা

ঢাকা, ২৫ এপ্রিল – বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মো. সাহাবুদ্দিন। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে সকালে নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ করেন।

নতুন রাষ্ট্রপতি এমন একসময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন যখন নির্বাচনের বাকি ৮-৯ মাস। নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে রাজনীতিতে বিরোধ তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় তিনি সব দলের আস্থা অর্জন করতে পারবেন কি না সে নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে। কারণ নতুন রাষ্ট্রপতিকে এখন পর্যন্ত স্বাগত জানায়নি মাঠের বড় বিরোধী দল বিএনপি। দলটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। রাজনৈতিক মহলের প্রত্যাশা, নতুন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসায় পদক্ষেপ নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে সংলাপের মতো উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে তার কাছে প্রত্যাশা করাই যায়।

গতকাল বেলা ১১টায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবনের দরবার হলে তাকে শপথপাঠ করান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

শপথপাঠ করার পর বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ফুল দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতিকে শুভেচ্ছা জানান। এরপর দায়িত্ব হস্তান্তরের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজ নিজ আসন বদল (চেয়ার বদল) করেন তারা।

চেয়ার বদলের সময় দরবার হলে উপস্থিত অতিথিরা করতালি দিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানান। এরপর নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শপথ নথিতে স্বাক্ষর করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ শতাধিক অতিথি এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, তিন বাহিনীর প্রধান, কূটনীতিক, পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।

এর আগে ১০টা ৫৫ মিনিটে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও স্পিকারকে সঙ্গে নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করেন। কালো মুজিব কোট ও সাদা পাঞ্জাবি পরেছেন মো. সাহাবুদ্দিন। দরবার হলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে একটি সামরিক ব্যান্ড আনুষ্ঠানিক সংগীত পরিবেশন করে তাদের স্বাগত জানায়।

আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর প্রথমেই মো. আবদুল হামিদ নতুন রাষ্ট্রপতিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন রাষ্ট্রপতিকে শুভেচ্ছা জানান। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ অন্যরা অভিনন্দন জানান। এ সময় নতুন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ড. রেবেকা সুলতানা, ছেলে আরশাদ আদনান রনিসহ পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের স্ত্রী রাশিদা খানম ও ছেলে সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহমেদ তৌফিকসহ পরিবারের অন্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

শপথ অনুষ্ঠানের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘মো. সাহাবুদ্দিন আজ সোমবার (গতকাল) ১১ বৈশাখ (২৪ এপ্রিল) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করেছেন।’ এ ছাড়া নতুন রাষ্ট্রপতির শপথগ্রহণের বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ সচিব স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়। মূলত শপথগ্রহণের মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করা হয়।

রাষ্ট্রপতির সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, গতকাল সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভবনে উঠেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে আজ মঙ্গলবার সকালে নতুন রাষ্ট্রপতিকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মো. সাহাবুদ্দিন দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

নতুন রাষ্ট্রপতির সংক্ষিপ্ত জীবনী : মো. সাহাবুদ্দিন ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবিলী ট্যাংকপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম চুপ্পু। বাবা শরফুদ্দিন আনছারী, মা খায়রুন্নেসা। ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি ও পরে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। বিসিএস (বিচার) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পেশা শুরু করেন।

নতুন রাষ্ট্রপতি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক, পাবনা জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সভাপতি ছিলেন। তিনি জেলা বাকশালের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। মো. সাহাবুদ্দিন ওই সময় সামরিক স্বৈরশাসকদের রোষানলে পড়ে তিন বছর জেল খাটেন এবং অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। দৈনিক বাংলার বাণীতে সাংবাদিকতাও করেছেন তিনি। তার অনেক কলাম বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে।

কর্মজীবনে তিনি জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত সমন্বয়কারী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পরপর দুবার বিসিএস (বিচার) অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন মো. সাহাবুদ্দিন। চাকরি থেকে অবসরের পর হাইকোর্টে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। তিনি ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুদক কমিশনার হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিন পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠা তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দৃঢ়তার পরিচয় দেন। সাবেক এই ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রাজনৈতিক বিরোধের মধ্যে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে : নতুন রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। গতকাল এক অভিনন্দন বার্তায় তিনি রাষ্ট্রপতির সাফল্য, সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, তারা মনে করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিক। তিনি সংবিধানকে রক্ষা করতে যথাযথ উদ্যোগ নেবেন। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনি একজন মাঠের রাজনীতিবিদ। তিনি সংবিধান ও আইনকানুন বোঝেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবেন তিনি। বিএনপির বিরোধিতা করা একটা বড় রোগ হয়ে গেছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ঢাকায় কূটনৈতিক মিশনের প্রধানরা নতুন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করছেন। এসব সাক্ষাতেও নির্বাচনের বিষয়টি উঠে এসেছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালি-উর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। আর নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেশের সব নাগরিকের অভিভাবক। সে হিসেবে তার চাপ তো একটু রয়েছেই। তার দীর্ঘ জীবনের কাজের অভিজ্ঞতা বলে, তিনি এই দায়িত্বপালনের জন্য শতভাগ যোগ্য।’

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি আমাদের অভিভাবক। একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা মনে করি নতুন রাষ্ট্রপতি অবশ্যই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবেন।’

তবে নতুন রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এত দিন বলে আসছিল এ বিষয়ে তাদের কোনো মন্তব্য নেই। তবে নতুন রাষ্ট্রপতি শপথ নেওয়ার পর দলটির পক্ষ থেকে বলা হলো রাজনৈতিক সংকটের এ সময় বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য সৃষ্টি করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা যেত। কিন্তু সেটা না করে সরকার জাতির কাছে অপরিচিত এক ব্যক্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে।

গতকাল গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলটির পক্ষে এসব কথা বলেন।

শপথ নেওয়ার আগে মো. সাহাবুদ্দিন একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তার অবস্থান থেকে যতটা ভূমিকা পালন করার সেটা করবেন’ বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মহাসচিব বলেন, ‘সংবিধানের বাইরে যাওয়ার তার (মো. সাহাবুদ্দিন) সুযোগও নেই। আর তার সেই সাহস আছে বলে আমরা মনে করছি না আরকি।’

রাজনৈতিক সংকট সমাধানে যদি রাষ্ট্রপতি সংলাপের উদ্যোগে নেন আপনারা যাবেন কি না প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যদির তো কোনো উত্তর থাকে না। বিষয়টা হচ্ছে, সেই ধরনের কোনো সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে কি না। যদি সরকার চায় তাহলে না রাষ্ট্রপতি চাইবেন। সরকার তো পরিষ্কার বলেই দিচ্ছে, এ নিয়ে (নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার) কোনো আলোচনা করব না, আলাপই করব না।’

সূত্র: দেশ রূপান্তর
আইএ/ ২৫ এপ্রিল ২০২৩

Back to top button