জাতীয়

ছাপিয়ে জোগান দেওয়া হলো ৪৯ হাজার কোটি টাকা

ঢাকা, ২২ ডিসেম্বর – কড়াকড়ি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক ধারায় নেমেছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। সরকারের রাজস্ব আদায়েও চলছে ধীরগতি। এমন বাস্তবতায় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে বাধ্য হয়েই ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। তবে এবার বাংকঋণের পুরোটাই জোগান দিতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। কারণ তারল্যে টান পড়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাসেই (১ জুলাই-১৫ ডিসেম্বর) সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিয়ে যাচ্ছে।

তবে এই পাঁচ মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি সরকার। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা।

প্রতিবছরই বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস থেকে- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয়

 

অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংকব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র খাত। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। তারল্য সংকট থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে চাইলেও প্রয়োজনীয়

ঋণ পাচ্ছে না সরকার। আবার ঋণ পেলেও সুদের হার বেশি দাবি করা হচ্ছে। কারণ করোনার পর চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক কয়েক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল সংগ্রহের খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নানা কড়াকড়িতে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা চলছে। বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ছাড়েও গতি নেই।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে তা মূল্যস্ফীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের আয় কম বলেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলে নতুন টাকা ছাপিয়ে দিতে হয়। এর প্রভাব সরাসরি মূল্যস্ফীতির ওপর পড়ে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমাতেই হবে। অন্যথায় মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও বেড়ে যাবে। এ জন্য সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের হ্রাস টানা দরকার, যাতে বাজেট ঘাটতি কম হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ ঋণের সুদহারের চেয়ে সরকারের বিল ও বন্ডের সুদহার তুলনামূলক কম হওয়া এবং চলমান তারল্য সংকটের কারণে বাণ্যিজিক ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকই টাকা ছাপিয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় ঋণের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

চলতি অর্থবছরের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৩৯ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত ৩০ নভেম্বর প্রথমবার সরকারের ব্যাংকঋণের স্থিতি ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এরপর ১৫ ডিসেম্বর শেষে ওই স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ১৫৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। যা গত ৩০ জুনে ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ফলে চলতি অর্থবছরের ৫ মাস ১৫ দিনে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৩১ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে কোনো ঋণই নেয়নি সরকার। উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ১৭ হাজার ৪৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। তবে একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেকর্ড ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছিল ২০ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ না দিয়ে উল্টো আগের নেওয়া ঋণের ৬ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছিল ২৭ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।

প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, এবার অর্থবছরের শুরু থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে না পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আসছে সরকার। যেমন- অর্থববছরের প্রথম মাস জুলাইতে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় প্রায় ৫৩১ কোটি টাকা। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো পরিশোধ দেখায় ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। ফলে ওই মাস পর্যন্ত সরকারের নিট ব্যাংকঋণ ঋণাত্মক ছিল ১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। এর পরের মাস আগস্টেও সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫ হাজার ১৫৮ কোটি টাকার ঋণ নেয়। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে শোধ দেখায় ৪ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। ফলে অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়েও সরকারের নিট ব্যাংকঋণ ছিল ঋণাত্মক ৯৫৫ কোটি টাকা। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে ব্যাংকঋণ নেওয়া বাড়তে শুরু করে সরকারের। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। ওই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া হয় ১৬ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিশোধ দেখানো হয় ৪ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। আর অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সরকারের নিট ব্যাংকঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই নেওয়া হয় ২৭ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ দেখানো হয় ৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা।

গত অর্থবছরেও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়েছিল সরকার। ওই অর্থবছরে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি তার আগের তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯০ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। এ সময়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ১৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। এর পরিমাণ প্রায় ৬৩২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) বৈদেশিক ঋণ সহায়তা ছাড় হয়েছে ১৪১ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ কম।

সূত্র: আমাদের সময়
আইএ/ ২২ ডিসেম্বর ২০২২

Back to top button