জাতীয়

বাংলাদেশ রেলওয়ের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

জাফর আহমেদ

ঢাকা, ৩০ জুলাই – দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়াতে প্রয়োজনীয় রেল যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলতে চায় সরকার। এজন্য দেশের সব রেললাইনকে ডুয়েলগেজে উন্নীত করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।

পরিকল্পনার আওতায় প্রথমে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বর্তমান মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজে উন্নীত করা হবে। এজন্য ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইনকে ডুয়েলগেজে উন্নীত করা হবে, যাতে ব্রডগেজ এবং মিটারগেজ দুই ধরনের ট্রেনই চলতে পারবে।

এই রেললাইন প্রথমে রাজধানী ঢাকাকে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরকে সরাসরি সংযুক্ত করবে।

এরপর রামুর হয়ে ঘুমধুম দিয়ে মিয়ানমার, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া হয়ে সিঙ্গাপুরসহ আরও অনেক দেশের সঙ্গে একে যুক্ত করে বৃহত্তর আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এরই মধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক সহযোগিতায় ২১২ কোটি ৬৪ লাখ টাকায় ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রকল্পপ্রস্তুতিমূলক সুবিধার জন্য কারিগরি সহায়তা’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।

২০১৫ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পটি এ বছর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড মহামারীর কারণে তা আগামী বছর শেষ করতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এই পরিকল্পনা সম্পর্কে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, “পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা চার থেকে পাঁচটা প্রকল্প নিয়ে একটি আম্ব্রেলা প্রজেক্ট গ্রহণ করব। যেমন চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত এখন মিটারগেজের সিঙ্গেল লাইন আছে, এটাকে ডুয়েল লাইন ও ব্রডগেজ করার জন্য একটি প্রকল্প হবে।

“এরপর লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ১৩৫ কিলোমিটার রেললাইন বর্তমানে মিটারগেজে আছে, এটাকে ডুয়েলগেজের সঙ্গে ব্রডগেজ করার জন্য আলাদা একটি প্রকল্প হবে। আবার টঙ্গী থেকে আখাউড়া পর্যন্ত আরেকটা প্যাকেজ হবে। এর সঙ্গে টঙ্গী থেকে ভৈরব ব্রিজ পর্যন্ত আরেকটি প্যাকেজ হবে। এভাবে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো রেললাইনটা ডুয়েলগেজ ও ব্রডগেজে রূপান্তর করা হবে।”

তিনি বলেন, “প্রতিবেশী মিয়ানমার, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া হয়ে সিঙ্গাপুরসহ আরও অনেক দেশের সঙ্গে একে যুক্ত করে বৃহত্তর আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির আলোচনা চলমান রয়েছে। বাণিজ্য আলোচনাকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো গড়ে তুলতে নিজস্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আমরা পরিকল্পিতভাবে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করব।”

মন্ত্রী সুজন বলেন, “ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই আমরা ইতিমধ্যেই যমুনার ওপরে ডুয়েলগেজ এবং পদ্মার ওপর দিয়ে ব্রডগেজ নির্মাণ করছি। মূলত আমাদের সমস্ত রেললাইনকেই আমরা ব্রডগেজে রুপান্তর করছি।”

গত ১৫ জুন সম্ভাব্যতা যাচাই প্রকল্পটির ওপর একটি ভার্চুয়াল আলোচনা হয়। ওই আলোচনা সভার সারসংক্ষেপে দেখা যায়, প্রকল্পটির আওতায় টঙ্গী থেকে দোহাজারী পর্যন্ত মোট ১২টি রেল সেতু তৈরি করতে হবে। টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, পুরনো ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ছোট ফেনী, মুহুরী, ফেনী, কর্ণফুলী, মাতামুহুরী ও পুরাতন মাতামুহুরী নদীর উপর এসব রেলওয়ে সেতু নির্মিত হবে।

পরিকল্পনার আওতায় মহেশখালী ও মাতারবাড়ির প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে রেল ট্র্যাক স্থাপন করা হবে। এছাড়াও এতে গাড়ি, ওয়াগন চলাচল, জ্বালানি সরবরাহ সুবিধা, বিজি রোলিং এবং স্টকের জন্য ডিপোর পাশাপাশি রেলওয়ে পরিষেবার জন্য বেশ কয়েকটি কার্যালয়ও নির্মাণ করা হবে।

রেল মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ঢাকা থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত রেল নিয়ে যাওয়ার জন্য যে প্রকল্পটি সাজানো হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে তার সমন্বিত ব্যয় কম-বেশি ৭০ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে রেল বিভাগের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম সলিমুল্লাহ বাহার বলেন, “এ রকম ব্যয় হতে পারে বলে প্রাথমিক একটা প্রাক্কলন করা হচ্ছে। তবে এখনও চুড়ান্ত কিছু করা যায়নি। অর্থায়নের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে আলোচনা চলছে। এরপরে চূড়ান্ত ব্যয় জানা যাবে।

“আসলে আমাদের টার্গেট সারা দেশের সকল রেল লাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তর করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়ে গেলে আর মিটারগেজ বাকী থাকবে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জামালপুর এবং ঢাকা-সিলেট রেলপথ। অর্থায়ন করা গেলে ২০৩৫ থেকে ৪০ সালের মধ্যে ওইসব রেললাইনও ব্রডগেজে রূপান্তর করার টার্গেট মন্ত্রণালয়ের রয়েছে।”

ঢাকা থেকে টঙ্গী, ভৈরব বাজার হয়ে চট্টগ্রাম ধরে কক্সবাজার যেতে ৪৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। অথচ ঢাকার কমলাপুর থেকে সরাসরি দক্ষিণমুখী কুমিল্লার কর্ডলাইন ধরে রেলপথ নির্মাণ করা গেলে ৯৪ কিলোমিটার পথ কমিয়ে আনার পাশাপাশি প্রায় দুই ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হয়।

বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “এক সময় ব্রিটিশদের বাংলার রেল উন্নয়নের যে দর্শন ছিল সেটা হচ্ছে আসাম ও কলকাতাভিত্তিক।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজধানীভিত্তিক ঢাকা-চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক করিডোর হয়ে ওঠার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “সেটাকে ইকোনমিক্যালি প্রফিটেবল এবং রিলায়েবল করা, দ্রুত যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের অনেক ধরনের উপযোগিতা তৈরি হয়। সেটা দেখে আশির দশকে কুমিল্লার এই কর্ডলাইনটার প্রস্তাবনা দেওয়া আছে।”

অধ্যাপক শামসুল হক জোর দিয়ে বলেন, “বর্তমানে দেশে যত প্রকল্প চলমান আছে তার মধ্যে (এই প্রকল্প) সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হতো। কিন্তু অজানা কারণে বা কেন এই প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হচ্ছে না তা নিয়ে মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়।”

সূত্র : বিডিনিউজ
এন এইচ, ৩০ জুলাই

Back to top button