সম্পর্ক

সুন্দর সমাজের জন্যে পারিবারিক শিষ্টাচার

পরিবার হচ্ছে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম একক; কিন্তু এ ক্ষুদ্রতম এককের ওপরই নির্ভর করে একটি জাতির সভ্যতা। পরিবারের ভালো-মন্দ রাষ্ট্রকেও আলোড়িত করে। পরিবার হচ্ছে মানুষ তৈরির কারখানা। পরিবারেই মানবশিশুর জন্ম হয়, পরিবারেই বিকশিত হয় এবং ধাপে ধাপে পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। পরিবারেই ভালো মানুষের জন্ম হয়, আবার খারাপ মানুষের জন্ম হয়।

পরিবারেই রাষ্ট্রনায়কদের জন্ম হয়, আবার সভ্যতা ধ্বংসকারী নরপিচাশের জন্ম হয়। এই যে ভালো-মন্দের পার্থক্য, তা গড়ে দেয় যে বিষয়টি তাহল পারিবারিক শিষ্টাচার।

শিষ্টাচার কী? মানুষের আচার-আচরণ, কথা, বার্তা, কার্যকলাপ, ভাববিনিময় ইত্যাদি সুন্দররূপে, ভদ্ররূপে প্রকাশিত হওয়াই শিষ্টাচার। শিষ্টাচার হল মানুষের চরিত্রের অলংকার।

যেসব গুণাবলি মানুষের চরিত্রকে সুন্দর, আকর্ষণীয় ও গৌরাম্বিত করে তুলে তার মধ্যে শিষ্টাচার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সত্য কথন, পরোপকার, ক্ষমা, দয়া-দানশীলতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা, ক্ষমা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, শালীনতা, বিনয়, ভদ্রতা ইত্যাদি বিশ্বজনীন গুণাবলি নিজের মধ্যে ধারণ, অনুশীলন এবং এর বিপরীত বিষয়গুলো বর্জন করাই হচ্ছে শিষ্টাচার।

শিষ্টাচারের অভ্যাস বা কৌশল রপ্ত করার প্রাথমিক ও প্রধান শিক্ষালয় হল পরিবার। একজন শিশু কিছু বুঝতে শিখলেই সে মা-বাবা, ভাইবোন এবং নিকটাত্মীয়ের কথা, বার্তা ও আচার-আচরণ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। সংসারে যদি মা-বাবার মধ্যে অশান্তির সৃষ্টি হয়, ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগে থাকে, তাহলে শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে ভবিষ্যতে নেতিবাচক মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

পক্ষান্তরে মা-বাবা বা সংসারের অন্য বড়দের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহঅবস্থান ও ভালোবাসা পূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠা শিশু পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়, একজন সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে। নৈতিক শিক্ষা পারিবারিক শিক্ষার একটি বড় দিক। নৈতিক শিক্ষা শিশুর মধ্যে সৎ গুণাবলির সঞ্চার করে। আর এ সৎ গুণ তার ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করে তোলে।

শিশুরা যা দেখে তাতেই প্রশ্ন করে। অনেক সময় বড়রা বিরক্ত হয়ে ছোটদের ধমক দিয়ে থাকে; কিন্তু এটি ঠিক নয়। এতে শিশুর শেখার বা জানার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। কারণ শিশুরা প্রশ্নই করে নতুন কিছু জানার জন্য। তাকে ধমক বা শাসন না করে বিষয়বস্তু বুঝিয়ে বলুন। তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করুন। পাশাপাশি এ শিষ্টাচার শেখাতে হবে, বড়দের জরুরি কোনো কথা বলার সময় যেন অহেতুক প্রশ্ন না করে বা বিরক্ত না করে।

অনেকে প্রাইভেসির নামে সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখে, আবার অনেকে সন্তানকে ভালোবাসে বলে নিজের প্রাইভেসি নষ্ট করে। সন্তানকে শেখাতে হবে কারও রুমে ঢুকতে হলে তার অনুমতি নেয়া প্রয়োজন।

পরিবারের বড়দের যথাযথ সম্মান এবং ছোটদের স্নেহ-ভালোবাসা দিতে হবে। কারও মতামতকে উপেক্ষা না করে ধৈর্যসহকারে শুনতে এবং গুরুত্ব দিতে হবে। তার মতামতও যুক্তিসঙ্গত এবং ফলপ্রসূ হতে পারে।

আরও পড়ুন: লাজুক ছেলেমেয়েদের বড় করতে ৭ টি টিপস

ছোট বলে পাত্তা না দিলে একসময় তার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি তাকে গুরুত্ব দিলে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে এবং বড়দের প্রতি বিশ্বস্ত ও অনুগত থাকবে।

পরিবারে ছোট-বড় সবার মাঝে পারস্পরিক সালাম বিনিময়ের অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বাবা-মা, কারও বাবা-মা না থাকলে স্ত্রীকে বলে বের হোন। ছোটরা অবশ্যই বড় কাউকে না বলে বাইরে যাবে না। বাসায় ফেরার পর অন্যদের খোঁজখবর নিন।

জীবন-জীবিকার তাগিদে ব্যস্ততা থাকতেই পারে। ব্যস্ততা যতই থাকুক না কেন, অন্ততপক্ষে দিনে একবার পরিবারের সঙ্গে খাওয়া প্রয়োজন।

খাবার টেবিলে বয়োজ্যেষ্ঠদের খাবার উঠিয়ে দিন বা সাধাসাধি করুন। এতে মনে তিনি সুখ পাবেন। ভাববে বৃদ্ধ হলেও তারা সংসারে অপাঙক্তেয় নয়। তাদের স্বাস্থ্যের নিয়মিত খোঁজখবর নিতে হবে। এতে তারা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে।

পারিবারিক কোনো বিষয়ে সবাই মিলে একমতে পৌঁছাতে চেষ্টা করুন। পারিবারিক অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করুন। পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহকেন্দ্রিক যে জীবন গড়ে উঠে তা কিন্তু সাধারণত সুখ-শান্তি দিয়েই শুরু হয়।

এ সুখ-শান্তি বজায় রাখতে হলে স্বামী-স্ত্রী পরস্পর-পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। একজনের কাজ কর্মে অন্যজনকে যথাসম্ভব সহযোগিতা করতে হবে।

স্ত্রী সংসারের কাজ করতে করতে অস্থির যাবে আর স্বামী সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে হুকুম দিয়ে যাবে এটি ঠিক নয়। গৃহস্থালি কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করায় অগৌরবের কিছু নেই। এটি শুধু কাজ নয়, এটি স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। নিজের আত্মীয়স্বজন বা অন্যদের সামনে তাকে হেয় করা উচিত নয়।

পরিবারের কোনো আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে অনেকে উটকো ঝামেলা মনে করেন। মেহমান এলে তাদের সাদরে গ্রহণ করুন এবং যথাসম্ভব আপ্যায়নের ব্যবস্থা করুন। হাসিমুখে কথা বলুন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ও সদ্ভাব বজায় রাখুন। তাদের সঙ্গে বিনয়ীভাবে কথা বলুন এবং বিপদে-আপদে সহযোগিতা করুন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করুন। মেহমান এবং প্রতিবেশীর মাধ্যমেই কিন্তু আপনার পরিবারের ইমেজ বাইরে প্রচারিত হয়।

ব্যক্তি জীবনে বিনয়ী ও ভদ্র আচরণে অভ্যস্ত হোন। ভুল করলে ক্ষমা প্রার্থনা করুন- এতে লজ্জার কিছু নেই। প্রশংসা করুন যখন কেউ সেটা প্রাপ্য হয়। কারণ প্রশংসা পেতে সবাই ভালোবাসে। বস্তুনিষ্ঠ বিতর্ক করুন, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়। নিজের মধ্যে শিষ্টাচারের গুণাবলি ধারণ করুন এবং তা নিজে ও নিজ পরিবারে অনুশীলন করুন। আমাদের সবার শিষ্টাচারই পরিবার এবং সমাজকে সুখময় ও শান্তিময় করে তুলবে।

এম এন / ২৩ অক্টোবর

Back to top button