অভিমত/মতামত

প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব সবার

ইমরান হুসাইন

প্রতিবছর বিশ্বের সকল মানুষকে সজাগ করে তোলার জন্য ২৮ জুলাই দিনটিকে বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।এজন্যই এই দিনে সকল দেশেই দিনটি যথাযথ ভাবে গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়ে থাকে। একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পায়, প্রতি বছরই নানা রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে নানা রকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের। ঝড়, বৃষ্টি, অগ্নিউৎপাত বন্যার স্বীকার হচ্ছি আমরা। যার ফলে পরিবেশে নেমে আসছে বিপর্যয়। এসব বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের কিছুটা রক্ষা করতে পারে বনভূমি কিন্তু দিনের পর দিন আমরা নির্বিচারে তাও নষ্ট করে ফেলছি। যা আমাদের জন্য ভয়ংকর বার্তা বয়ে আনতে পারে।বর্তমান সময়ে লক্ষ্যো করা যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বন্যায় কবলিত। যা প্রকৃতির উপর অত্যাচার, অবিচার ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ বা ব্যবস্থা না নেওয়ার ফল।

প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব কেবল সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন সংস্থানের নয়। এ দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির বা প্রতিটা নাগরিকের। কেননা, প্রকৃতি আমাদের আশ্রয় দাতা, আমাদের অক্সিজেনের উৎস। তাই সময় থাকতেই আসুন সবাই নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি, প্রকৃতিকে রক্ষা করি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ দিবসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে এ বিশ্বকে বাঁচিয়ে পরিবেশকে সংরক্ষণ করার অঙ্গীকার নিয়ে জনসচেতনতার মাধ্যমে প্রকৃতি সংরক্ষণের সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৮ জুলাই দিবসটি বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। আজকের এই দিনে উপলব্ধি করতে হবে বিশ্ব পরিবেশ সম্পর্কে ও পরিবেশের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে। আজ সব থেকে জরুরি বিশ্বের সকল মানুষকে বিশ্ব পরিবেশ ও পরিবেশের গুরুত্ব সম্পর্কে জানানো। আজকের এই দিনটি নিছক কিছু কর্মসূচির জন্য নয়। সবাইকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তোলাই মূল লক্ষ্য। তাহলে দিনটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।

প্রকৃতি হলো সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি। আর তাই প্রকৃতি সংরক্ষণ হলো ইবাদতের সামিল। শুধু তাই নয় সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত স্বাভাবিক ও নৈসর্গিক বস্তুকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশ মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের পক্ষে সহায়ক। নির্মল বাতাস,বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত খাদ্য সুস্থ ও সুন্দর ভাবে মানুষকে বাঁচাতে সহায়তা করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ও মানুষের লাগামহীন দূষণ মূলক কর্মের ফলে প্রতিনিয়তই ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। যেই পরিবেশ মানুষকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে নিজের সবটুকু দিয়ে লালন পালন করছে এই সমাজের মানুষকে, অন্যদিকে সেই নির্মম মানুষ গুলোই নির্বিচারে ধ্বংস করছে প্রকৃতি। যার ফলে প্রকৃতি দিন দিন ভয়ানক রুপ ধারণ করছে।

বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে লাগামহীন ভাবে ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া। শুধু তাই নয়, পরিবেশ দূষণের ফলে জলজ প্রাণীদের জলে থাকতে কষ্ট হয় কারণ তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পায় না। উদ্ভিদরা সতেজ থাকতে পারছে না। বন জঙ্গল অবাধে উজাড় হচ্ছে ফলে বাসস্থান সংকটে পড়ছে বন্য প্রানী সমুহ।আর পরিমন্ডলের এই সমস্ত কিছু পরিবর্তনের ফলে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। আর এইভাবে চললে প্রাণীজগৎ একদিন প্রায় শেষের পথে চলে যাবে বলে বিজ্ঞানীদের সতর্কতা শোনা গিয়েছে। তাই সর্বস্তরে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়ে থাকে সকল দেশগুলোতে সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে।

পরিবেশের বিপর্যয়ের প্রভাবে অনেক বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে,ঘূর্ণিঝড়, বন্যা,দাবানল,সুনামি,বন্যা, খরা প্রভৃতির মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের হার বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বেড়েই চলেছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যেকারণে তলিয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চল গুলো।এ বিষয়ে ২০০৭ সালের জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেলে বলা হয়ে ছিলো ২০৫০ সালের মধ্যে বঙ্গপোসাগরের পানির উচ্চতা ১ মিটার পর্যন্ত বাড়বে।এর ফলে মালদ্বীপ নামক দেশটা পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে।এমনকি বাংলাদেশের উপকূলের ১৭ শতাংশ ভূমি চলে যাবে সমুদ্র গর্ভে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটিতে বাড়ছে লবনাক্ত তা ও বাড়ছে বন্যা। মাটির গভীতরে পানিক স্তর নেমে যাওয়াই দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানিক সংকট। ঋতু বৈচিত্র্যের ওপর পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে মারাত্নক প্রভাব লক্ষ্যো করা যাচ্ছে সাম্প্রতিক কালে।

প্রকৃতি কে সতেজ বা সংরক্ষণ করতে হলে প্রয়োজন বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনার মাধ্যমে সবাইকে প্রকৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে সবাইকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারে। যদি আমাদের সমাজ তথা দেশের মানুষ এ সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে এসব কর্মসূচি অবশ্যই বৃথা। এখনও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পরিবেশ রক্ষায় স্পষ্ট কোন ধারনা না আসায় পরিবেশ রক্ষায় দ্বায়িত্বপালনে তারা উদাসীন।এখনও বন জঙ্গল নাশে উৎসাহী মানুষ। যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রতিনিয়তই। পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশ, রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অরণ্য ধ্বংস না করা, ভূমিক্ষয় রোধ করা।

একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রোধ করার জন্য প্রয়োজন মোট ভূমির শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে মোট ভূমির মাত্র, প্রায় ১৬ ভাগ বনভূমি আছে।যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।তবে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৯ভাগ এবং ওয়াল্ড রিচার্স ইনস্টিটিউট এর হিসাব অনুযায়ী ৫ ভাগ।এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩.৫ ভাগ। যার ফলে পরিবেশে দেখা দিয়েছে বিরুপ প্রভাব। সময় মতো বৃষ্টি নেই,রোদ নেই।অনিয়নে চলছে ঘূর্ণিঝড় বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তান্ডবে এলোমেলো হয়ে গেছে সারাদেশ।যার শক্তি হ্রাস পেতে থাকে বনভূমির কারনে। কিন্তু বনভূমির পরিমাণ কমার কারণে ক্রমেই প্রবল আকার ধারণ করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলো।

আমাদের চির পরিচিত সঙ্গা যে, আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সকল কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। অর্থ্যাৎ গাছপালা, নদী-সাগর, মাটি, পানি, বায়ু সকল কিছুই পরিবেশের অর্ন্তভুক্ত। আর পরিবেশের স্বাভাবিক অবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের জীবন-যাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমন কারখানার কালো ধোয়া বায়ু দূষণ করে। বায়ুদূষণের ফলে দূষিতবায়ু প্রবেশ করে শ্বাসনালীকে বিষাক্ত করছে। ফলে শ্বাসকষ্টহ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হলে কলকারাখানার কালো ধোয়া নির্গত বন্ধ করতে হবে। মুলত পরিবেশের এই উপাদান গুলোর সুষম ব্যবহারই পারে পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখতে আর পরিবেশ দূষণ রোধ হলেই প্রকৃতি আবার তার সতেজ রুপ ফিরে পাবে।

পরিবেশকে দূষণ মুক্ত বা পরিবেশকে সকল প্রকার ধংসাত্মক থেকে সুরক্ষা রাখতে বিভিন্ন রকম প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই পরিবেশকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও পরিবেশকে সুরক্ষা রাখতে সবাই সচেতনতা অবলম্বন করবে। এছাড়া কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য যেমন,বনভূমি ধ্বংস কঠর ভাবে রোধ করতে হবে। ব্যাপক ভাবে বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে।

বর্তমান জ্বালানি পরিবর্তন করে বাতাস,সৌর ও পানি বিদ্যুৎ এর মতো পুনর্ব্যবহার যোগ্য জ্বালানির প্রচলন করতে হবে। শিল্প কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ পরিশোধের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে হবে। কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সারের ব্যবহার কমাতে হবে। এবং পরিবেশ দূষণ রোধের কাজকে সামাজিক আন্দোলনে রুপ দান করতে হবে।

প্রকৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব কেবল সরকার বা কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন সংস্থানের নয়। এ দায়িত্ব প্রতিটি ব্যক্তির বা প্রতিটা নাগরিকের। কেননা, প্রকৃতি আমাদের আশ্রয় দাতা, আমাদের অক্সিজেনের উৎস। তাই সময় থাকতেই আসুন সবাই নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি, প্রকৃতিকে রক্ষা করি। সবাই একসাথে আওয়াজ তুলি, ” প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, প্রকৃতি কে সংরক্ষণ করুন” অন্তত এটা মনে রাখুন যে আমরাই প্রকৃতি আর প্রকৃতির মাঝেই আমাদের বসবাস। তাই প্রকৃতিকে রুখ করার দায়িত্ব আমাদেরই। বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ দিবসে এটাই হোক সবার প্রত্যয়।

লেখক : শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সাংগঠনিক সম্পাদক বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

এম ইউ/২৮ জুলাই ২০২১

Back to top button