জাতীয়

রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে কমনওয়েলথের প্রতি আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ঢাকা, ২২ অক্টোবর- লন্ডনে কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘টুওয়ার্ডস সাসটেইনেইবল জাস্টিস, অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যান্ড রিটার্নস : দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস ইনটু ফোর্থ ইয়ার’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনা সভা। খবর বাসস।

সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ আন্তর্জাতিক আদালত ও বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্যোগের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা ও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কমনওয়েলথের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে সুস্পষ্ট ও জোরালো উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা এবং তাদের স্বদেশে পুনর্বাসন করা এ মুহূর্তের জন্য সবচেয়ে জরুরি।”

বুধবার এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ হাই কমিশন লন্ডন, যুক্তরাজ্যের কানাডা হাই কমিশন ও কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলের যৌথ উদ্যোগে এ আলোচনা সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। এতে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়নবিষয়ক দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক আহমদ গেস্ট অব অনার হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন অনুষ্ঠানে কি-নোট পেপার উপস্থাপন করেন।

যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম, কানাডার হাইকমিশনার মিসেস জেনিস শ্যারেট এবং কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড অনুষ্ঠানে কো-চেয়ারের ভূমিকা পালন করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সতর্ক করে বলেন, “অত্যাচার-নির্যাতনের দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলার যে সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট দেশে তৈরি হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।” তিনি কমনওয়েলথের ‘চেয়ার-ইন-অফিস’হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকারকে আইসিজি-তে চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় পরামর্শকের ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।

ব্রিটিশ মন্ত্রী লর্ড আহমেদ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানকে যুক্তরাজ্যের অন্যতম অগ্রাধিকার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “যুক্তরাজ্য সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলসহ সকল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”

তিনি কক্সবাজারে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং মিয়ানমারে তাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনে সব সময়ই বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন কি-নোট পেপারে মিয়ানমারের সরকারকে দেওয়া রোহিঙ্গাদের ১৩টি দাবির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে বলেন, এসব অপূর্ণ দাবি এখনো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধান বাধা হয়ে আছে। দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৮২ সালের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান এবং তাদের বিভিন্ন অধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা।

আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সহায়তায় ৪৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়েছে যুক্তরাজ্য

পররাষ্ট্রসচিব রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের এসব দাবির প্রতিফলন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি কিগালি শীর্ষ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য একটি আলাদা ঘোষণার প্রস্তাব করেন।

স্বাগত বক্তব্যে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কমনওয়েলথের চেয়ার-ইন-অফিস হিসেবে যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের প্রতি অব্যাহত সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য যুক্তরাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান।

কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মহান মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশ নিজ সামর্থ্যেরও বেশি রোহিঙ্গাদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এখন আমাদের সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে।

কানাডার হাইকমিশনার মিসেস জেনিস শ্যারেটে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও আইনি প্রক্রিয়ায় তার সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনঃব্যক্ত করেন।

গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা হুসেইন টোমাসী আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়ে আইসিজে-তে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমারের মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন।

আরও পড়ুন: অর্থনীতিতে অবদান রাখায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান অর্থমন্ত্রীর

রোহিঙ্গা বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সর্বদলীয় সংসদীয় দলের চেয়ার রুশনারা আলী এমপি আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারকে কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমারের চলমান মামলায় বিশেষ ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি মিয়ানমারের ওপর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এর জোটভুক্ত দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াকে অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, এর ফলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত কারেল ভ্যান ওস্টেরম এক ভিডিও বার্তায় গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমারের মামলায় তার সরকারের ভূমিকা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনঃব্যক্ত করেন।

উল্লেখ্য, নেদারল্যান্ডস এবং কানাডা আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া বনাম মিয়ানমারের মামলার ক্ষেত্রে গাম্বিয়াকে সহযোগিতা করছে।

যুক্তরাজ্যে বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থার সভাপতি মং তুন খিন বলেন, তার পিতামহ এক সময়ে বার্মার সংসদ সদস্য ছিলেন। তবু তার পরিবারও পরবর্তীতে সেখানে সামরিক জান্তার হাতে নির্যাতিত হয়েছে এবং তাদের রাজনৈতিক, নাগরিক এবং সামাজিক অধিকারও হরণ করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে নির্যাতিত রোহিঙ্গা নারী হাসিনা বেগম মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাকে ও প্রতিবেশী নারীদের কীভাবে নির্যাতন করেছে তার মর্মস্পর্শী বিবরণ তুলে ধরেন।

উচ্চ পর্যায়ের এ আলোচনা সভায় আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। এদের মধ্যে ছিলেন ইউএন মানবাধিকার কাউন্সিলের মিয়ানমার (আইআইএমএম) বিষয়ক স্বাধীন তদন্ত কমিটির প্রধান নিকোলাস কাউমিজিয়ান, আইসিজের বাংলাদেশ ও গাম্বিয়ার কাউন্সিলর অধ্যাপক পায়াম আখাভান, সুরক্ষা বিষয়ক গ্লোবাল সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ড. সাইমন অ্যাডামস, মিয়ানমারের সাবেক স্পেশাল রেপোর্টিয়ার অধ্যাপক ইয়াংহি লি এবং মিয়ানমার সম্পর্কিত জাতিসংঘের স্বতন্ত্র আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রাক্তন তদন্তকারী এবং লিগ্যাল অ্যাকশন ওয়ার্ল্ডের নির্বাহী পরিচালক মিস্ অ্যান্টোনিয়া মুলভে। এই আলোচনা সভায় যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, সিভিল সোসাইটি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, গবেষক এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন।

সূত্র : দেশ রূপান্তর
এম এন / ২২ অক্টোবর

Back to top button