ঈদ মানেই উৎসব। মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনে দুটি বড় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। কাল বাংলাদেশে সবাই ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। এই ঈদের সঙ্গে হজও সম্পৃক্ত। এ বছর সৌদি আরবের বাইরের কোনো দেশ থেকে কেউ হজ পালন করতে পারেননি। গত বছরও সৌদি আরবের বাইরের কোনো দেশ থেকে কেউ হজ করতে পারেননি। বহু দেশে কোরবানিও হয়নি। সম্ভবত আমাদের ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত শেষ জামানার দাজ্জাল এসে গেছে। মনে হয় করোনা সেই দাজ্জাল। আজ দেড় বছর হয় করোনার প্রতাপ বিশ্বময় সমানে চলছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বড় বড় পণ্ডিত এই করোনার গ্রাসে পতিত হয়েছেন। গত বছরও আমাদের যেসব প্রিয়জন সঙ্গে ছিলেন তাঁরা আজ কবরে সমাহিত। আর আমরা যারা বেঁচে আছি, তারা এই দানবের ভয়ে আতঙ্কিত জীবন যাপন করছি। এই আতঙ্কের মধ্যে আবার ঈদ এসেছে। মুমিন মুসলমানরা এই ঈদ উদযাপনে ব্যস্ত। সরকার বাধ্য হয়েছে এই ঈদ উপলক্ষে কিছুদিনের জন্য লকডাউন তুলে নিতে। টেলিভিশন খুললেই দেখা যাবে হাজার হাজার মানুষ ঘরপানে ছুটছে। এবার গরুর ফলন বাংলাদেশে ভালো হয়েছে। কোরবানির জন্য ভারতের গরু আনতে হবে না। গরুগুলোও বেশ মোটাতাজা। লাখ লাখ টাকা দাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দুর্দিনেও ১৭ লাখ অভাবী মানুষের জন্য যে সাহায্য দিয়েছেন, তাতে তারা এই ঈদের মৌসুমে ভুখাফাঁকা থাকবে না। এই সরকারি সাহায্য গোটা দেশের জন্য পর্যাপ্ত নয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু নর-নারী ও শিশু এই ঈদ পালন করতে পারবে কি না সন্দেহ। কোনো কোনো বছর সৌদি আরবে কোরবানির মাংস পাহাড় সমান হয়ে যায়। সৌদি সরকার প্যাকেটজাত করে বিভিন্ন মুসলিম দেশে তা পাঠায়। বাংলাদেশেও পাঠিয়েছে। কিন্তু কোরবানির সেই মাংস নিয়েও দুর্নীতি হয়েছে। সৌদি সরকার যে মাংস পাঠিয়েছিল গরিবদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য, সেই মাংস দুর্নীতিপরায়ণ কিছু মানুষের সুবাদে বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে। এবার সম্ভবত সৌদি আরব থেকে মাংস আসবে না। কিন্তু বাংলাদেশে যত গরু কোরবানি হবে, তাতে গরিবদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য মাংসের অভাব হবে না। কিন্তু গরিবরা সেই মাংস পাবে কি?
ব্রিটিশ আমলে গরু-ছাগল কোরবানির পর তার চামড়া গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হতো। তখন দেশে চামড়াশিল্প না থাকলেও বিদেশে ওই চামড়া বিক্রি হতো বেশি দামে। গরিবরা দুটি পয়সা পেত। তারপর শুরু হয় জামায়াতি দানবের জুলুম। ধর্মের নামে তারা কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে পশুর চামড়া সংগ্রহ শুরু করে। তখন তারা বলত, এই চামড়া বিক্রির অর্থে তারা এতিমখানা পরিচালনা করছে। তাদের তহবিলে তখনো মধ্যপ্রাচ্য থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসত না। মানুষকে মিথ্যা কথা বলে কোরবানির চামড়া নিয়ে তা বিক্রি করে সেই টাকায় জামায়াতি রাজনীতি শুরু হয়। এভাবে বাংলাদেশের গরিব মুসলমানরা রোজার ঈদের ফিতরার টাকা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছে, তেমনি বঞ্চিত হয়েছে কোরবানির ঈদের গরুর চামড়া বিক্রির টাকা থেকে। পাকিস্তান আমলে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যখন প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়, তখন শেখ মুজিবুর রহমান সেই মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। বছরটা আমার মনে নেই, মন্ত্রী শেখ সাহেব ঢাকায় ঈদের জামাতে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতে গিয়ে ঘোষণা করেন, ‘এখন থেকে কোরবানির পশুর চামড়া আর ধর্মের নামে লুটপাট করতে দেওয়া হবে না। সরকার এই চামড়া সংগ্রহ করবে এবং তার বিক্রির অর্থ জাকাত ফান্ডে দান করবে।’ শেখ সাহেবের এই ব্যবস্থা কার্যকর হয়নি। কারণ তার কিছুদিন পরেই আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভার ক্ষমতা হারান। এখন বাংলাদেশে কোরবানির পশুর চামড়া ধর্মীয় কারণ দর্শিয়ে লুটপাট করার আশঙ্কা কম। আমাদের নিজস্ব চামড়াশিল্প গড়ে উঠেছে। সুতরাং চামড়া কোথায় যাবে তা যাঁরা গরু কোরবানি দেন, তাঁরা সবাই জানেন। এই ঈদের পরদিনই দেখা যাবে গরুর চামড়ার বাজার বসেছে। এই সময় সরকারকে আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এই বাজার থেকে কোনো প্রকার দূষণ চারদিকে না ছড়ায়।
এখন আসি উৎসবের কথায়। এবার মানুষ দলে দলে ঘরমুখো হয়েছে। ভয় হয়, তাদের এই উন্মাদনা উৎসবকে শোকে পরিণত না করে। সরকারের স্বাস্থ্যবিধি ভাঙলে শুধু দেশের ক্ষতি হবে না, সরকারও দারুণ বিপাকে পড়বে। এই ভয়ে সরকার ঈদের ছুটির পরে আরো কঠোর লকডাউনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সরকার যতই কঠোর হোক, সাধারণ মানুষ যদি নিজেদের নিরাপত্তার কথা না ভেবে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে, তাহলে তাদের অবস্থা হবে ‘কলা খাওয়া’ শিশুর মতো। অসুস্থ শিশুকে মা কিছুতেই ওষুধের ট্যাবলেট খাওয়াতে পারছিলেন না। তখন কলার মধ্যে ঢুকিয়ে শিশুকে তা খেতে দিয়েছিলেন। খাওয়া শেষ হলে মা জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, তুমি কলা খেয়েছ তো? শিশু বলল, কলা খেয়েছি কিন্তু ভেতরের বিচিটা ফেলে দিয়েছি। শিশুর রোগ আর ভালো হয়নি। আমাদের দেশের মানুষও যদি লকডাউন শিথিল হওয়ায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে, তাহলে তারা নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। সরকার ঈদের পর নতুন করে লকডাউন দেবে। আমার ভয় সেই লকডাউন সত্ত্বেও দেশে কী অবস্থা দেখা দেয়। দাজ্জাল প্রস্তুত হয়েই আছে। ইউরোপ থেকে সে তার বাহু গুটিয়েছিল। এখন আবার তা প্রসারিত করেছে। বিজ্ঞানীরা বলতে পারেন না এই যে করোনার তৃতীয় ঢেউ আসছে, তাতে ইউরোপে কত লাখ লোক মারা যাবে। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের অবস্থা কী হবে, তা ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়। তবু ঈদের উৎসবে সতর্কতার সঙ্গে শামিল হতে সবাইকে আহ্বান জানাই। সবাইকে বলি, ঈদ মোবারক। যে যেখানে যেমনভাবে আছেন ঈদের উৎসব সতর্কতার সঙ্গে পালন করুন, সুস্থ থাকুন, নিরাপদ থাকুন—এবারের ঈদে এই আমার প্রার্থনা। বিশেষ করে কালের কণ্ঠ’র সবাইকে জানাই ঈদ মোবারক। তাঁদের ঈদ যেন সুখের ও শান্তির হয় এবং তাঁরা গ্রামের বাড়িতে গেলে সুস্থ ও নিরাপদে ফিরে আসেন। এটা আমার কামনা। আমাদের ধর্মশাস্ত্র বলে ঈদুল আজহা ভোগের নয়, ত্যাগের। ৬০ বছর আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের ঈদ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে আমাদের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী আবুল মনসুর আহমদ লিখেছিলেন, ‘ত্যাগ বরণের ঈদকে আমরা এখন ভোগের ঈদ করিয়াছি। কোরবানির মাংস এখন গরিবরা পায় না। যিনি কোরবানি দেন সেই ধনী ব্যক্তির পারিবারিক উৎসবের উপকরণ হয়। ঈদের পর কলিকাতার রাস্তাঘাট কোরবানির পশুর পরিত্যক্ত হাড়-মাংসে ভর্তি হইয়া থাকে। করপোরেশন আর কতটুকু পরিষ্কার করিবে? সাধারণ মানুষেরা নিজেদের নাগরিক দায়িত্ব পালন না করিলে তাহাদের ঈদের উৎসব অপরের জন্য বিপজ্জনক হইয়া উঠিতে পারে। নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধির প্রসার ঘটিতে পারে। এই দিকে আমি সাধারণ মুসলমানদের এবং করপোরেশনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ঈদ যেন সকলেরই উৎসব হয়। শুধু মুসলমানের নয়।’
আবুল মনসুর আহমদের এই সতর্কবাণী কিছুদিন আগেও ঢাকা শহরের জন্য সত্য ছিল। ঢাকার বর্তমান দুই সিটি করপোরেশন ঈদের পর কোরবানির বর্জ্য শহর থেকে সরিয়ে দিতে যথেষ্ট তৎপরতা দেখায়। তাতেও সব জঞ্জাল পরিষ্কার হয় না। এদিকে করপোরেশন দৃষ্টি দিলে ভালো হয়। ধর্মীয় উৎসব পালন ভালো। কিন্তু ধর্মোন্মাদনা ভালো নয়। এ বছর ভারতে গঙ্গাস্নান ও কুম্ভমেলা নিয়ে যে ধর্মোন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে করোনা নামক দাজ্জাল দানবের উত্পাত বেড়েছিল ১০ গুণ। ইউরোপেও ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়। যেমন ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাস। গত ক্রিসমাস বাড়িতে বাড়িতে কার্ড বিতরণ এবং শুভেচ্ছা বিতরণের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। কোনো হৈচৈ ছিল না। নববর্ষের আগের রাতে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী একত্র হয়ে যে উন্মাদনার সৃষ্টি করত, তা-ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চারদিকের অবস্থা ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের ধর্মীয় উৎসবগুলোও যেন উৎসব হিসেবে পালিত হয়, ধর্মোন্মাদনায় পরিণত না হয়। কোরবানির ঈদ উপলক্ষ করে কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন।’ কিন্তু আজ আমাদের কোরবানির উৎসবে সেই শক্তির উদ্বোধন নেই। আছে ভোগের উন্মাদনা। তাতে পুণ্য অর্জিত হয় না, বরং তাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। আমার মননশীল পাঠকদের রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকটি আরেকবার পাঠ করার অনুরোধ জানাই। আবারও সবাইকে জানাই এই পবিত্র ঈদ উপলক্ষে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
এম ইউ