ঢাকা, ২২ অক্টোবর- শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনে পাস হওয়া বহুল আলোচিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ কার্যকরের পর জরিমানার ভয়ে ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গ কমেছে। চালকরা আগের চেয়ে নিয়মকানুন বেশি মানছে। লাইসেন্সবিহীন চালক খুব একটা নেই। ভাঙাচোরা গাড়িরও ফিটনেস সনদ আছে। সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠ পর্যায়ে কাজ করা পুলিশ কর্মকর্তারা এ অভিমত দিয়েছেন। রাস্তায় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বেড়েছে বলে দাবি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষেরও।
কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বছর খানেক আগে আইন কার্যকরের পর সড়কে নিয়ম ভঙ্গের মামলা কমলেও মৃত্যু, দুর্ঘটনা কমেনি। আছে আইন প্রয়োগে দুর্বলতা ও শিথিল করার চাপ। শ্রমিক, চালকরা এখনও নিয়োগপত্র পাননি। দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে তহবিল গঠন হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু পরিবর্তন ও উন্নতি হলেও সড়কে পুরোপুরি নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা অর্জন এখনও বহুদূর। এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস।
মঙ্গলবার বিজয় সরণিতে কথা হয় তেজগাঁও ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট রইসুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আগে দিনে পাঁচ থেকে সাতটি মামলা করতেন। নতুন আইন প্রয়োগ শুরুর পর গড়ে দুটি মামলা করেন। তার ভাষ্য, শুধু লাইসেন্স ও ফিটনেস সনদ নয়, জরিমানার ভয়ে লেন মানতেও আগের চেয়ে বেশি সচেতন চালকরা। উল্টো পথে গাড়ি এখন তেমন চলে না। তল্লাশিতে প্রায় সব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ও ট্যাক্স টোকেনের কাগজ হালনাগাদ পাওয়া যায়।
আগের আইনে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর জরিমানা ছিল ৫০০ টাকা। গত ১ নভেম্বর কার্যকর হওয়া আইনে তা বেড়ে হয়েছে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা। সার্জেন্ট রইসুল ইসলাম জানালেন, লাইসেন্স না থাকলে মোটরসাইকেল চালককে চার হাজার এবং চার চাকার গাড়ির চালককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে মামলা দেওয়া হয়।
আগের আইনে নিবন্ধনহীন গাড়ি চালানোর জরিমানা ছিল দুই হাজার টাকা। এখন তা ৫০ হাজার টাকা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানোর জরিমানা দুই হাজার থেকে বেড়ে ২৫ হাজার টাকা হয়েছে। সড়কে সরাসরি আইনের প্রয়োগ করা পুলিশ সার্জেন্টরা বলছেন, জরিমানা বাড়ায় হেলমেটবিহীন চালকের মতো নিবন্ধনহীন গাড়িও আর নেই।
তবে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল জায়গা এখনও নড়বড়ে। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার নিবন্ধিত গাড়ির বিপরীতে লাইসেন্সধারী চালক ২৭ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪৯ জন। দরপত্র জটিলতায় লাইসেন্স প্রিন্ট পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে ৯ লাখ ১৩ হাজার ২৫৮ জন। সব মিলিয়ে চালক সংকট প্রায় ৯ লাখ। কিন্তু সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) দুই বছর ধরে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে পারছে না। পেশাদার চালকদের লাইসেন্সের শ্রেণি পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ ফিটনেস সনদ দেওয়ার মতো জনবলই নেই বিআরটিএর।
সাত বছর ঝুলে থাকার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পাস হলেও নানা চাপে সড়ক আইন পুরোপুরি প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা ফেরানোর টাস্কফোর্সের প্রধান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে গত নভেম্বরে পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের বৈঠকে জরিমানা ছাড়া ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময় গত ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। পরে তা বেড়ে ৩১ ডিসেম্বর করা হয়েছে। শিথিল করার শর্তে পেশাদার চালকের লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ বাড়ানো হয়েছে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। তার আগ পর্যন্ত মিনিবাস চালানোর লাইসেন্সধারী চালক ভারী ট্রাক চালালেও মামলা হবে না। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত থাকবে কর পরিশোধের ধারা। এক বছর আগে গঠিত টাস্কফোর্সের কার্যক্রম স্থবির। একটি বৈঠকের পর আর কোনো তৎপরতা নেই ‘উচ্চক্ষমতার’ এই টাস্কফোর্সের। তবে শুরু থেকেই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বলছেন, আইনে তাদের স্বার্থ রক্ষা হয়নি। মালিক-শ্রমিকের ওপর জেল-জরিমানার বোঝা চাপানো হয়েছে। টাস্কফোর্সের সদস্য তথা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী সমকালকে বলেছেন, আইনে ১০ থেকে ৫০ গুণ জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। একজন শ্রমিক এত টাকা কোথায় পাবে?
আইন শিথিলসহ ৯ দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট ডেকে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে কর্মসূচি স্থগিত করে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম বলেছেন, সড়কে মৃত্যুর ঘটনায় চালকের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা দেওয়ার সুযোগ বাতিল চান তারা। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছেন।
তবে আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আইন সংশোধন করতে হলে সংসদে যেতে হবে। আইনের কিছু ধারা শিথিল ও সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কিছু ধারার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, আইন কার্যকরের পর মালিক-শ্রমিকদের সচেতনতা ও সহযোগিতায় সড়ক আগের চেয়ে নিরাপদ হয়েছে। মালিক-শ্রমিকরা আইনের বিরোধী নয়। দুর্ঘটনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। কিন্তু স্বার্থ পরিপন্থি আইন থাকলে সড়কে কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা আসবে না।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদারও বলছেন, সড়ক আগের চেয়ে নিরাপদ। তবে তার অভিমত, এক দিনে শৃঙ্খলা আসবে না। শুধু মালিক-শ্রমিক নয়, যাত্রী-পথচারী সবাইকে সচেতন হতে হবে। চেয়ারম্যান জানান, বিআরটিএ আইন প্রয়োগে আগের চেয়ে কঠোর হয়েছে।
যুগোপযোগী আইনের দাবিতে সাত বছর আগে আন্দোলনে নামা কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, জরিমানার ভয়ে ওপরে ওপরে কিছু পরিবর্তন এসেছে। হেলমেট পরা ও লাইসেন্সধারী চালক বেড়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের এই সদস্য বলেছেন, মূল জায়গা ঠিক হয়নি। প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের চালকের ওপর আইনের প্রয়োগ হলেও বড় কোম্পানির বাসের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কারণ, এর মালিকরা পরিবহন, সরকারেরও নেতা। পরিবহন খাতের নৈরাজ্য দূর হয়নি। যাত্রী, চালক, পথচারীর জীবন নিরাপদ হয়নি এখনও।
আরও পড়ুন: জানুয়ারিতে আসছে ৫ সেট মেট্রোট্রেন
পরিসংখ্যানও একই কথা বলছে। নিরাপদ সড়কের দাবিতে দুই যুগ ধরে আন্দোলন করা ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বাধীন সংগঠন নিসচার হিসাবে ২০১৯ সালে চার হাজার ৭০২টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার ২২৭ জনের। এসসিআরএফ নামে আরেকটি সংগঠনের হিসাবে, আইন কার্যকরের পর চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সড়কে প্রাণ গেছে তিন হাজার ৭৫ জনের। করোনার কারণে ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৬৮ দিন যান চলাচল বন্ধ থাকার দিনগুলো বাদ দিলে, আইনের আগে-পরে মৃত্যুর সংখ্যায় হেরফের হয়নি।
আইন কার্যকরের আগে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ছিল চার লাখ তিন হাজার ৫৩৩টি। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে পাঁচ লাখ সাত হাজার। তবে মামলা কমেছে। আগে গড়ে রাজধানীতে দিনে সাত হাজার মামলা হতো ট্রাফিক আইনে। ঢাকা মহানগর পুলিশ মামলার সংখ্যা প্রকাশ না করলেও সূত্র জানিয়েছে, পয়েন্ট অব সেল (পওস) মেশিনে জরিমানা চালুর পর এখন দিনে হাজার খানেক মামলা হচ্ছে।
প্রায় তিন লাখ বাস ও পণ্যবাহী যানবাহনের অধিকাংশে আকার, উচ্চতা, আসন ব্লু-বুকের চেয়ে বেশি। বছরের পর বছর এসব যানবাহন ফিটনেস পেয়েছে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত গাড়ির আকৃতি পরিবর্তনের সাজা সর্বোচ্চ তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা। প্রায় সব গাড়িই নিয়ম না মানায় এখন আইন প্রয়োগ করা যাচ্ছে না।
আজ সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও অংশীজনদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। তা রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে বড় পর্দায় প্রচার করা হবে মালিক-শ্রমিকদের উদ্যোগে। বনানীতে বিআরটিএ ভবন থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে দেখা দিয়েছে টানাপোড়েন। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাজাহান খানের বিরুদ্ধে মামলা করায় গত বছর ইলিয়াস কাঞ্চনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন পরিবহন নেতারা। তিনি বিআরটিএ ভবনের অনুষ্ঠানের মঞ্চে থাকলে তাতে যোগ দিতে নারাজ মালিক-শ্রমিক নেতারা।
ওসমান আলী বলেছেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচার করবেন টার্মিনালে। কিন্তু বিআরটিএর অনুষ্ঠানে যাবেন না। মিরসরাইয়ে ট্র্যাজেডি, তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুদিনসহ বছরে তিন দিন নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করবে শ্রমিক ফেডারেশন।
সূত্র: সমকাল
এম এন / ২২ অক্টোবর