শিক্ষা

এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে একাধিক বিকল্প পরিকল্পনা

ঢাকা, ১৬ জুলাই – করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পিছিয়ে যাওয়া এ বছরের এসএসসি ও এইচএসসি সমমান পরীক্ষা নিয়ে একাধিক বিকল্প পরিকল্পনার কথা জানাল সরকার। করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এসএসসি ও সমমান এবং ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এইচএসসি ও সমমানের সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নিতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটা সম্ভব না হলে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, পরিস্থিতি অনুকূলে এলে এবার এসএসসি ও এইচএসসির গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নেওয়া হবে। প্রতি ১০০ নম্বরের ক্ষেত্রে ৫০ নম্বর এবং তিন ঘণ্টার পরিবর্তে দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া একাধিক প্রশ্নের মধ্যে স্বল্পসংখ্যকের উত্তর শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। আর আবশ্যিক বিষয়ে আগের পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে মূল্যায়নের মাধ্যমে নম্বর দেওয়া হবে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সরকারের এসব পরিকল্পনার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী। তবে সরকারের এ পরিকল্পনার বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে শিক্ষাবিদরা বলেছেন, পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে আবশ্যিক বিষয় বাদ দেওয়া সমীচীন হবে না। আর অ্যাসাইনমেন্ট মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে পারেন। তাই নিরপেক্ষতার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দিয়ে মূল্যায়ন করানো যেতে পারে। আর অভিভাবক ফোরামের নেতারা বলেছেন, দু-তিন রকম সিদ্ধান্ত থাকায় শিক্ষার্থীরা দোটানায় ঝুলেই থাকল। তাই তারা পরিপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমেই মূল্যায়ন চান।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে অ্যাসাইনমেন্ট ও সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে অথবা শুধু সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমেও মূল্যায়ন করা হতে পারে। সেটি পরে জানানো হবে।

তিনি বলেন, গত বছর নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে করোনা সংক্রমণের হার অনেক কমে এসেছিল। এ বছর টিকা প্রদান আবার শুরু হয়েছে এবং ব্যাপক হারে টিকার নিবন্ধনও চলছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাপক সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে টিকা প্রদান সম্ভব হবে। আশা করছি, নভেম্বর-ডিসেম্বরে সংক্রমণ হার হয়তো বা গত বছরের মতো বা তারও চেয়ে কম হবে। কভিড-১৯ পরিস্থিতি অনুকূল হলে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হবে।

যেভাবে পরীক্ষা :সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তিন ঘণ্টার পরিবর্তে পরীক্ষা হবে দেড় ঘণ্টায়। আর প্রশ্নপত্র এখন যেভাবে রচনামূলক হয়, সেভাবেই হবে। তবে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন বাছাই করার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ পাবে।

যেমন আগে ১০টি প্রশ্নের মধ্য থেকে হয়তো আটটির উত্তর দিতে হতো। এখনও হয়তো সেই ১০টি প্রশ্নই থাকবে। তবে তার মধ্যে তিনটি বা চারটির উত্তর দিতে বলা হতে পারে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বেছে নেওয়ার সুযোগ বেড়ে যাবে। আর প্রতি বিষয়ে ১০০ নম্বরের বদলে ৫০ নম্বর করা হতে পারে। তবে ৫০ নম্বরকে ১০০-তে রূপান্তর করে পরীক্ষার ফল দেওয়া হবে।

জানা গেছে, মানবিক, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগের পাশাপাশি কারিগরি ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নৈর্বাচনিক বিষয়ে গ্রুপভিত্তিক তিনটি বিষয়ের (ছয় পত্রে) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। চতুর্থ বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হবে না। আবশ্যিক বিষয় বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, আইসিটি ও ধর্ম বিষয়ে পরীক্ষার্থীদের আগের পাবলিক পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিং করে মূল্যায়নের মাধ্যমে নম্বর দেওয়া হবে। অর্থাৎ নৈর্বাচনিক বিষয়ে প্রাপ্ত পরীক্ষার নম্বর ও আবশ্যিক বিষয়ে আগের পরীক্ষার সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে একজন শিক্ষার্থীর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে।

কারিগরির ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কারিগরিতে নবম ও একাদশ শ্রেণিতে বোর্ড পরীক্ষা হয়। তাদের পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব না হলে ওই দুই শ্রেণির পরীক্ষাও মূল্যায়ন করা হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এসএসসি ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা জেএসসি বা জেডিসি পরীক্ষায় আবশ্যিক বিষয়গুলো (যেমন- বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি ও ধর্ম) অধ্যয়ন করেছে। এইচএসসি ও সমমান পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় আবশ্যিক বিষয়গুলো, যেমন- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, আইসিটি ও ধর্ম বিষয়গুলো অধ্যয়ন করেছে। ওই বিষয়গুলোর মূল্যায়ন হয়েছে এবং সেগুলোর নম্বর সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু নৈর্বাচনিক বিষয়গুলোর মূল্যায়ন বোর্ডগুলো করেনি। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু গ্রুপভিত্তিক বিষয়গুলোর মূল্যায়নের প্রয়োজন রয়েছে, সে কারণেও এই গ্রুপভিত্তিক বিষয়ের মূল্যায়ন করা জরুরি। যেমন- বিজ্ঞান গ্রুপের ক্ষেত্রে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান। এ ছাড়া বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর আবশ্যিক বিষয়ে পরীক্ষা নিতে গেলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়বে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বিবেচনায় ২০২১ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের জন্য ৬০ কর্মদিবস এবং এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের জন্য ৮৪ কর্মদিবসের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস প্রকাশ করা হয়েছে। সেই সিলেবাসের আলোকেই পরীক্ষা নেওয়া হবে।

বিকল্প অ্যাসাইনমেন্টে মূল্যায়ন :এসএসসির অ্যাসাইনমেন্টের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে এসএসসি ও সমমানের অ্যাসাইনমেন্ট ১৮ জুলাই থেকে দেওয়া শুরু হবে। ১২ সপ্তাহে মোট ২৪টি অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। প্রতি সপ্তাহে দুটি করে মোট ২৪টি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবে শিক্ষার্থীরা। প্রতিটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে মোট আটটি করে অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে। এর মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি সম্পন্ন হবে।

এইচএসসির অ্যাসাইনমেন্টের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, এইচএসসি ও সমমানের অ্যাসাইনমেন্ট ২৬ জুলাই শুরু হবে। ওই স্তরের শিক্ষার্থীদের ১৫ সপ্তাহে মোট ৩০টি অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে। তাদেরও গ্রুপভিত্তিক তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে মোট ছয়টি পত্রে (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) এই অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। প্রতি পত্রে পাঁচটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। তাদেরও সপ্তাহে দুটি করে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে। এভাবে তাদের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস সম্পন্ন হবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, অ্যাসাইনমেন্টগুলোর মূল্যায়ন কতটা সঠিক হচ্ছে, সেটিরও মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে। সে জন্য সারাদেশে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নের কপি এনে সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। ভালোভাবে এগুলোর মূল্যায়ন হলে অ্যাসাইনমেন্টের ফলাফল থেকেও পরীক্ষার ফলাফলে কিছুটা অংশ যাবে। সেটা ১০ থেকে ১৫ নম্বর হতে পারে। সেই মূল্যায়ন যথাযথ না হলে শুধু সাবজেক্ট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমেই ফল প্রকাশ করা হবে।

ফরম পূরণ :শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ঈদুল আজহার পর অনলাইনে পরীক্ষার ফরম পূরণ শুরু হবে। পরীক্ষার ফিও নেওয়া হবে অনলাইনে। আবশ্যিক বিষয়গুলো মূল্যায়নের বাইরে থাকায় ফিও কমিয়ে দেওয়া হবে। এসব বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলো দ্রুত নির্দেশনা জানাবে। মন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ না কমলে প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সুযোগ নেই।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব আমিনুল ইসলাম খান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ প্রমুখ।

শিক্ষাবিদদের প্রতিক্রিয়া :গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এ দুটি পরীক্ষার বিষয়ে সরকারের একটি পরিকল্পনা পাওয়া গেল। এ জন্য সাধুবাদ জানাই। তবে লক্ষণীয়, যে তিনটি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো প্র্যাকটিক্যাল-নির্ভর। ওই সময়ে কীভাবে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে, তার একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার। আর অ্যাসাইনমেন্টে মূল্যায়ন ও প্রধান শিক্ষকদের অ্যাসাইনমেন্ট সংগ্রহ পদ্ধতি আরও শক্তিশালী করা দরকার। পরীক্ষার ক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠানের খাতা অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা দেখেন। অ্যাসাইনমেন্টেও তা করা দরকার মূল্যায়নে নিরপেক্ষতার জন্য।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সাবেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, গত বছর যাদের অটোপাস দেওয়া হলো, তারা এখনও বসে আছে। তাদের ভর্তি করা যায়নি। তাহলে এত তাড়াহুড়ো করে অটোপাস দেওয়া হলো কেন? একইভাবে এবার যাদের সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা বা অ্যাসাইনমেন্টে মূল্যায়ন করতে চাওয়া হচ্ছে, তারাও তো ফল প্রকাশের পর বসেই থাকবে। তাই উপযুক্ত সময়ে পরীক্ষা নেওয়ার অপেক্ষা করা প্রয়োজন। অ্যাসাইনমেন্টের নামে যা করা হচ্ছে, তা আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে না। শিক্ষার্থীরা বই দেখে দেখে লেখে, নইলে শিক্ষক ও অভিভাবকরা তা লিখে দেয়। আর বাংলা, ইংরেজি, গণিত বাদ দিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতাই নেই।

এ ব্যাপারে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, একদিকে পরীক্ষা, অন্যদিকে অ্যাসাইনমেন্ট- দুই ভিন্ন সিদ্ধান্তে পরীক্ষার্থীরা দোটানায় থেকেই গেল। এমন দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। আমরা চাই, শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হোক। পরীক্ষা ছাড়া অন্য কোনো মূল্যায়ন সাধারণ অভিভাবকরা চায় না।

সূত্র : সমকাল
এন এইচ, ১৬ জুলাই

Back to top button