ঢাকা, ১৫ জুলাই – দিনব্যাপী মানবিক কর্মসূচির মাধ্যমে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাতে নেওয়া সেই কর্মসূচিতে গতকাল বুধবার এক সঙ্গেই ছিলেন পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণীয় পর্যায়ের নেতারা। একই দিন সকালে রাজধানীর বারিধারায় এরশাদের স্মৃতিবিজড়িত প্রেসিডেন্ট পার্কে ঘটে অন্য এক ঘটনা। ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ট্রাস্ট’-এর ব্যানার পেছনে রেখে দলটির নতুন কমিটি ঘোষণা দেন এরশাদপুত্র এরিক এরশাদ।
পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান চাচা জিএম কাদেরের পদকে অবৈধ ঘোষণা করেন এরিক। তার পরিবর্তে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় রওশন এরশাদকে। আর মা বিদিশা সিদ্দিক, ভাই রাহগীর আল মাহি সাদ ওরফে সাদ এরশাদকে রাখা হয় কো-চেয়ারম্যান পদে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করা হয় এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদের নাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম মেম্বার অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী প্রমুখ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জাপার বর্তমান প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান করা হয়েছে তার অনুমতি না নিয়েই। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী আপাতত নীরব রয়েছেন। অন্যদিকে রাহগীর আল মাহি সাদকে মিলাদের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্ট পার্কে। তাকেও না জানিয়ে কমিটি ঘোষণা করেন এরিক। আর কমিটি প্রস্তাবের সময় পাশ থেকে ছেলেকে উৎসাহ দেন বিদিশা সিদ্দিক। এ সময় তিনি বলেন, ‘এরিকের প্রস্তাবিত নতুন কমিটি কাজ শুরু করবে। আমার দুই ছেলে সাদ ও এরিককে নিয়েই এরশাদের স্বপ্নের দেশ গড়তে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করব আমরা।’
নতুন কমিটির বিষয়ে জানতে চেয়ে রওশন এরশাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ আছেন বলে জানান একাধিক নেতা। সাদ এরশাদের মুঠোফোনেও কল করে পাওয়া যায়নি। এমনকি তাকে খুদেবার্তা পাঠালেও তার জাবাব দেননি। দলীয় সূত্র অবশ্য জানায়, বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই কথা বলবেন রওশন ও সাদ এরশাদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘সাদ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছে- তাকে মিলাদের কথা বলে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। যে কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটার সঙ্গে সাদ নেই। আর শ্রদ্ধেয় রওশন এরশাদ খুব অসুস্থ। যে কারণে পল্লীবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে এবার তিনি বাসাতেও মিলাদের ব্যবস্থা করেননি।’
এদিকে এরিক জাপার নতুন কমিটি দিতে পারেন কিনা- এর জবাবে জাপা নেতাদের ভাষ্য, জাতীয় পার্টিতে এই মুহূর্তে এরিকের কোনো পদ নেই। তাই দলের রীতি অনুযায়ী তিনি কমিটি গঠন করতে পারেন না। শুধু এরিক কেন, দলের কেউ নতুন কমিটি দিতে পারেন না। এরশাদ জীবদ্দশায় নিজে ভাই জিএম কাদেরকে দলের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। পরে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি হয় এবং নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জিএম কাদের। সুতরাং কাউন্সিল ছাড়া নতুন কমিটি ঘোষণা করার কোনো সুযোগ নেই। বরঞ্চ জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১(১) (ক) উপধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে চেয়ারম্যান দলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
জাপা নেতারা আরও জানান, এরিককে দিয়ে দলের এই অগঠনতান্ত্রিক কাজটি করাচ্ছেন মূলত বিদিশা সিদ্দিক। জাপার কমিটি দেওয়া এখানে মুখ্য নয়। একটা বিব্রতকর পরিবেশ তৈরি করে এরশাদের সম্পত্তি ভোগ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে জাপার দুই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এরশাদ জীবদ্দশায় বিদিশাকে ডিভোর্স দিয়ে যান। আইনগতভাবেই তারা আলাদা হয়েছেন। পরে তিনি এরশাদের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করেছেন। এমনকি ‘শত্রুর সঙ্গে বসবাস’ নামে একটি বই লিখে সাবেক প্রেসিডেন্টের চরিত্র হননও করেছেন তিনি। কিন্তু এরশাদের প্রয়াণের পর তার সম্পত্তির লোভে এরিকের মাতৃত্বের দাবি নিয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট পার্কে। সামনে এরিককে রেখে তিনি সব সম্পত্তি ভোগ করছেন। আর এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই তিনি জাপার নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলেন।
জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিদিশা সিদ্দিক ভালো করেই জানেন যে, তিনি দলের এবং এরশাদ পরিবারের কেউ নন। তাই ছেলে এরিককে সামনে আনছেন। তাকে দিয়ে অনৈতিকভাবে চাচা জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে কথা বলাচ্ছেন। এটা সামাজিক ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ।’
এদিকে কাকরাইলে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ত্রাণ দেওয়ার সময় ‘নতুন কমিটি’র প্রতিক্রিয়ায় জিএম কাদের বলেন, ‘দল করার বিষয়ে আমাদের আপত্তি নেই। তবে একসঙ্গে দুটি দল কেউ করতে পারবেন না। গঠনতন্ত্রে এটা স্পষ্ট লেখা আছে।’ জাপার প্রস্তাবিত নতুন কমিটির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমরা জানি না। এটা আমরা গ্রহণ করি নাই।’
অনুষ্ঠানে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘এরশাদ না থাকলে জাতীয় পার্টি থাকবে না- এমন বক্তব্য ছিল সবার। কিন্তু আমরা সে ধারণা ভুল প্রমাণ করেছি। জাতীয় পার্টি একটি আদর্শ। জাপা সংসদে যেভাবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে, আমার মনে হয় না এমনটা আর কেউ করতে পেরেছে।’ জাপা মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘জাতীয় পার্টি যে কোনো অবস্থায় মানুষের পাশে থাকবে। করোনার দুঃসময়ে মানুষকে বাঁচাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই।’
সূত্র : আমাদের সময়
এম এউ, ১৫ জুলাই