শিক্ষা

কীভাবে কাটবে শিক্ষার সংকট

সাব্বির নেওয়াজ

ঢাকা, ১৩ জুলাই – দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম এত দীর্ঘকাল বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রায় দেড় বছর টানা ছুটিতে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সাল জড়িয়ে অন্তত তিনটি শিক্ষাবর্ষের সূচি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মহামারি কবে কমবে, সে অনিশ্চয়তার মধ্যে শিক্ষার বিপুল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন করণীয় কী, তা নিয়ে ভাবছেন শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রস্তাব তারা দিচ্ছেন। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে বলে তারা তাগিদ দেন।

এই সময়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তর পর্যন্ত চার কোটি শিক্ষার্থী আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে পড়ে গেছে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চললেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এর বাইরে। বাতিল হয়েছে পাঁচটি পাবলিক পরীক্ষা। চলতি বছরের পরীক্ষাগুলো নিয়ে অনিশ্চয়তা। বেড়েছে ঝরে পড়া, বাল্যবিয়ে ও শিশুর অপুষ্টির হার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেড় বছরের সেশনজট।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, এক রকম ভেঙে পড়া শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড় করাতে সার্বিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে হবে সরকারকে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক ও সুশীল সমাজ- সবাইকে শিক্ষার ক্ষতি পূরণের কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে।

ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যাবে, তা নিয়ে দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রতিবেদক। মোটা দাগে তাদের বক্তব্যে যা উঠে এসেছে তা হলো- শিক্ষার্থীদের টিকাদান দ্রুত ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেষ করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আরও জোরদার করা, পাবলিক পরীক্ষার সিলেবাস যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্সের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দ্রুত শেষ করা, দূরশিক্ষণ চালু করা, প্রতিষ্ঠান খোলার পর দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ছুটির দিনে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া, বাল্যবিয়ে রোধে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো, গরিব পরিবারগুলোকে আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে ড্রপআউট ও শিশুর অপুষ্টি দূর করা, অটোপাসের পরিবর্তে ছোট করে হলেও সংক্ষিপ্ত পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া এবং দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক কাউন্সেলিং করানো। তারা বলেন, অনলাইন শিক্ষা কখনও ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার নূ্যনতম সুযোগও হাতছাড়া করা যাবে না।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল বাংলাদেশ। এসব দেশে এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখ।

বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অনির্দিষ্টকাল তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে চলা সম্ভব নয়। তাই সব স্তরের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের টিকাদান নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যত দ্রুত সম্ভব খুলে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ক্লাসরুম এডুকেশনের কোনো বিকল্পই হয় না। শিক্ষার বড় অংশ হলো তার ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো। অনলাইনের মাধ্যমে থিওরিটিক্যাল টপিক পড়ানো সম্ভব হলেও জ্ঞানের সব দিক তার অধীনে আসে না। আর মাথায় রাখতে হবে আমাদের দেশে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী সমাজের সুবিধাবঞ্চিত অংশ। তাদের কাছে তো কোনো ডিজিটাল ডিভাইসই নেই।

ভর্তি কার্যক্রম কীভাবে হয়েছে? খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি কমে গেছে। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যেখানে ভর্তিতে কোনো টাকা নেওয়া হয় না, সেখানেও ভর্তির হার ব্যাপকভাবে কম। রাজধানী ঢাকায়ও তা-ই।

করোনার আগে ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে ঝরে পড়ার হার অনেক বাড়বে বলে সংশ্নিষ্টদের আশঙ্কা। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিয়ে। বিশেষ করে শহরের বস্তিবাসী এবং চর ও হাওর অঞ্চলের শিশুরাই বেশি ঝরে পড়ে।

একটি তথ্য হচ্ছে, কুষ্টিয়ার একটিমাত্র কলেজের একাদশ শ্রেণির সাত ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে এক মাসে।

রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন বলেন, অন্তত এক-চতুর্থাংশ শিক্ষার্থী তো এখনও ভর্তিই হয়নি। মেসেজ পাঠিয়ে ও নোটিশ দিয়েও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না।

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, বহু অভিভাবক পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। তাদের সন্তানেরা অ্যাসাইনমেন্ট দিতেও আসছে না। সারাদেশে একই অবস্থা। এই শিক্ষার্থীদের ফের ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘স্কুল খোলার পর সব শিশুকে ফিরিয়ে আনতে একটা অভিযান পরিচালনা করার প্রয়োজন হবে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে।’ তিনি মনে করেন, সরকার থেকে শিক্ষকদের এবং স্কুলকে প্রণোদনা দেওয়া দরকার, যেমন মিড-ডে মিল বা দুপুরের গরম খাবার। এ ছাড়া পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত ক্লাসেরও ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুলগুলোতে সার্বিক তদারকি বাড়াতে হবে। সব শিক্ষার্থীকে পর্যায়ক্রমে টিকা দিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের শক্ত রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার।’

পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাস ব্যাখ্যা দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, এতে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানসম্মত শিক্ষা গুরুতর ব্যাহত হয়। গত বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অটোপাস দিয়ে অনেকটাই সমালোচনার মুখে পড়েছিল শিক্ষা প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আপাতত কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাস দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে এ বছরের ৪০ লাখ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এখন মহাসংকটে। পরীক্ষা হবে কিনা, তা এখনও জানায়নি সরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডাসহ অনেক দেশ করোনার ক্ষতি কাটাতে অনলাইন শিক্ষাকে জোরদার করেছে। কোনো কোনো দেশ অনলাইনে পরীক্ষাও নিচ্ছে। প্রতিবেশী দেশের পশ্চিমবঙ্গ সরকার করোনার শুরুতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে খুলে দিয়েও আবার বন্ধ করেছে। উন্নত দেশগুলো অনলাইন শিক্ষা জোরদার করলেও আমাদের দেশে তা বড় চ্যালেঞ্জ। শহরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করলেও মফস্বলের শিক্ষার্থীদের সে সুযোগ নেই। অনেকের ডিভাইস নেই, অনেকের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট নেই। গ্রামে ইন্টারনেটের প্রচ ধীরগতি, যা দিয়ে অনলাইন ক্লাস ঠিকমতো করাও সম্ভব নয়।

ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিমউল্লাহ খন্দকার বলেন, গ্রামাঞ্চলে করোনার প্রকোপ কম। বেছে বেছে সংক্রমণ কম থাকা অঞ্চলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া যেতে পারে।

একই অভিমত দিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমদের প্রস্তাব, সংক্রমণ কমে এলে দূরবর্তী অঞ্চলের ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেওয়া যেতে পারে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা করতে হবে। দেড় বছরের ক্ষতি পোষানোর পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশেষ করে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে জোর দিতে হবে।’

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ৩০-৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী যে অনলাইন শিক্ষায় সম্পৃক্ত হতে পারেনি অথবা কার্যকরভাবে অংশ নিতে পারেনি, তা উপলব্ধি (নিরূপণ?) করা একান্ত জরুরি। এই শিক্ষার্থীদের একটি ডাটাবেস বা নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে এবং কিছুটা সংগতিপূর্ণ পরিবারের শিক্ষার্থীদের সহজ কিস্তিতে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ পৌঁছে দিতে হবে। এই সময়ে ঝরে পড়াদের জন্য পরিকল্পনা নিতে হবে। তিনি দরিদ্র ও প্রান্তিক পরিবারের সন্তানদের বৃত্তি বাড়ানো, স্কুলে এক বেলা খাবার, এই সময়ে পড়াশোনায় যারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে বা পিছিয়ে পড়েছে তাদের জন্য ছুটির দিনে আলাদা ক্লাস নেওয়ার প্রস্তাব করেন।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, আপাতত অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করার সঙ্গে দূরশিক্ষণ চালু করা যেতে পারে।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির অন্য সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, কবে কখন কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে, তা নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। তবে যাদের জন্য শিক্ষা, যাদের সন্তানদের শিক্ষা, যারা সে শিক্ষা দেন, যারা ব্যবস্থাপনা করেন, তাদের মতামত সবচেয়ে গুরুত্ববহ। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাব রাখতে চাই যে, তাদের মতামত সংগ্রহ করে সংকট উত্তরণে একটি কমিটি গঠন করা দরকার।’

সূত্র : সমকাল
এন এইচ, ১৩ জুলাই

Back to top button