পর্যটন

অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম খৈয়াছরা ঝর্ণা

এম মাঈন উদ্দিন

প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। অনেকে রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাহাড়ের পাদদেশে তাবু টাঙ্গিয়ে অবস্থান করছেন। প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে, সবুজের চাদরে ঢাকা বনানী রূপের আগুন ঝরায়, যেখানে প্রকৃতি খেলা করে আপন মনে, ঝুম ঝুম শব্দে বয়ে চলা ঝর্ণাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে ধুয়ে সজীব করে তুলছে খৈয়াছরা ঝর্ণায়।

গ্রামের সবুজ শ্যামল আঁকা বাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে শরীরটা একটু হলেও ভিজিয়ে নেয়া যায় নিঃসন্দেহে। মিরসরাইয়ের এই খৈয়াছরায় আট স্তরের ঝর্ণা দেখতে দেশি বিদেশি পর্যটকের ভিড় পড়েছে। দেশের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক ঝর্ণাটি দেখতে প্রতিদিন ছুটে যাচ্ছে হাজার হাজার দেশি বিদেশি পর্যটক। খৈয়াছরা এলাকার পাহাড়ে অবস্থান বলে এর নামকরণ করা হয়েছে খৈয়াছরা ঝর্ণা।

শুধু যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত আর অবকাঠামো উন্নয়ন করলে সরকার এ পর্যটন স্পট থেকে রাজস্ব আয় করতে পারবে।

উপজেলার খৈয়াছরা ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে ঝর্ণার অবস্থান। এর মধ্যে এক কিলোমিটার পথ গাড়িতে যাওয়ার পর বাকি পথ যেতে হবে পায়ে হেঁটে।

বাঁশের সাকো, ক্ষেতের আইল, আঁকাবাকা পাহাড়ী পথ, ছরা, অন্তত ৪টি পাহাড় পেরিয়ে যখন ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে যখন গা ভিজাবে পর্যটক, তখন মনে হবে পথের এই দুরত্ব খুব সামান্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ব্যাপক প্রচারের ফলে প্রতিদিন ভিড় করছেন পর্যটকরা।

ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকরা সবুজে সমারোহ পাহাড় আর ঝর্ণা দেখতে যেখানে প্রকৃতির অপরুপ সৃষ্টি সেতুবন্ধন করে। পাহাড়ের সবুজ রং আর ঝর্ণার স্বচ্ছ জল মিলেমিশে একাকার হয়েছে মিরসরাইয়ের প্রাকৃতিক জলপ্রপাত খৈয়াছরা ঝর্ণায়। প্রকৃতির নান্দনিক তুলিতে আঁকা এ ছবি দেখে মুগ্ধ হচ্ছে দেশের ভ্রমণপিয়াসী মানুষ। যারা একবার খৈয়াছরা ঝর্ণা দেখেছেন তাদের মনে একটিই প্রশ্ন উঁকি দেয় বার বার, ‘দেশে এমন সৌন্দর্যের ঝর্ণা দ্বিতীয়টি আর আছে কি না।’

আরও পড়ুন: বিনা ভিসায় বাংলাদেশীরা ঘুরতে পারেন যেসব দেশে

এমনই এক নান্দনিক ঝর্ণা পর্যটকদের আকর্ষন করছে যা খৈয়াছরা ঝর্ণা নামেই পরিচিত। খৈয়াছরা এলাকার পাহাড়ে অবস্থান বলে এর নামকরণ করা হয়েছে খৈয়াছরা ঝর্ণা।

খৈয়াছরা এলাকার বাসিন্দা ডা. আলমগীর বলেন, “ভুঁইয়ার টিলায় প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রবাহিত হচ্ছে ঝর্ণাটি। পাহাড়ি ঝোঁপের কারনে মানুষ তখন খুব একটা ওই জায়গায় যেতনা। গত ৪-৫ বছর থেকে সেখানে পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েক মাস ধরে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি।”

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যেন পর্যটকের ঢল নেমেছে ঝর্ণা দেখার জন্য। পর্যটকদের অনেকেই এসেছেন ফেসবুকে ঝর্ণার ছবি দেখে।

কুমিল্লার মাতলুব আহমেদ, বগুড়ার আহমেদ জাকি জিমি, ঢাকার শাহীদ সরকার, যশোরের আবদুল্লাহ গাজী, একেএম রনি ফেসবুকে খৈয়াছরা ঝর্ণার ছবি দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তাই সবাই মিলে এসেছেন এখানে।

আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “দেশের বিখ্যাত অনেক প্রাকৃতিক ঝর্ণা আমি দেখেছি। খৈয়াছরা ঝর্ণার যে সৌন্দর্য তা দেশে দ্বিতীয়টি আর আছে কিনা আমার জানা নেই।”

আব্দুল্লাহ গাজী বলেন, “আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ, সোনালি ধানক্ষেত, দুপাশের সবুজ রং আর রিমঝিম ঝর্ণার কলকল শব্দে প্রাণ জুড়িয়ে যায় সবার। এ যেন প্রকৃতির অবিশ্বাস্য এক রুপের খেলা। যা না দেখে বিশ্বাস করা যায়না।”

ঝর্ণার শেষধাপ পর্যন্ত ঘুরে আসা পর্যটক জাবেদ কাইসার বলেন, “অনেক প্রশস্ত জায়গা জুড়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে শেষ ধাপে।” তিনি যোগ করেন, “ঝর্ণার শেষ ধাপ পর্যন্ত যারা আসবেন তারা বাংলাদেশের সেরা কোনো প্রাকৃতিক ঝর্ণা উপভোগ করবেন নিঃসন্দেহে।”

চট্টগ্রাম থেকে আসা পর্যটক দম্পতি আওলাদ হোসেন এবং নাসরিন সুলতানা বলেন, “অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ঝর্ণায় আসতে। পাহাড় আর ঝর্ণার সৌন্দয্য আমরা মুগ্ধ।”

তবে রাস্তার অসুবিধার কারনে ঝর্ণায় আসা কষ্টসাধ্য বলে মন্তব্য করেন এই পর্যটক দম্পতি।

খৈয়াছরা ঝর্ণাকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে স্কুল পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী এবং এলাকার বেকার যুবকরা গাইড হিসেবে কাজ করছেন। পর্যটকদের ঝর্ণায় নিয়ে যাওয়া আসায় সহায়তা করছেন তারা। এজন্য পর্যটক ভেদে প্রতিবার ৫০০-৭০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাদের।

স্থানীয় খৈয়াছরা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণীর শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, “স্থানীয় প্রায় ২০ জন ছেলে গাইড হিসেবে কাজ করছে। এদের ১০ জন স্কুল শিক্ষার্থী। প্রতি শুক্রবার পর্যটকের ভীড় বেশি থাকে। তাই তারা গাইড হিসেবে কাজ করে। দিনে দুইবার পর্যটকদের নিয়ে গেলে তাদের আয় হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা।”

স্কুল শিক্ষার্থী তারেক, সোহেল, হাসান জানান, দেশের পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশিরা ঝর্ণা দেখতে আসছেন। দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান তারা।

বন বিভাগের বারৈয়াঢালা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা অরুন বরণ চৌধুরী বলেন, “২০১০ সালে সরকার বারৈয়াঢালা ব্লক থেকে কুন্ডেরহাট (বড়তাকিয়া) ব্লকের ২৯৩৩.৬১ হেক্টর পাহাড়কে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। খৈয়াছরা ঝর্ণা জাতীয় উদ্যানের আওতাভুক্ত একটি দর্শনীয় স্থান। জাতীয় উদ্যানকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় করে তুলতে কাজ করছে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানসহ ব্যবস্থাপনা কমিটি।”

ইতিমধ্যে খৈয়াছরা ঝর্ণাকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় করে তুলতে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি এসএম সরওয়ার উদ্দিন বলেন, “খৈয়াছরা ঝর্ণাকে ঘিরে রাস্তা, রেস্টুরেন্ট, কটেজ ইত্যাদি নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলে এখান থেকে প্রচুর রাজস্ব আয় সম্ভব হবে।”

মিরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, “খৈয়াছরা ঝর্ণার কথা শুনেছি। তবে আমি এখনো যায়নি। আগামী সমন্বয় সভার মিটিংয়ে আলোচনার মাধ্যমে খৈয়াছরা ঝর্ণায় পর্যটকদের অবাধ যাতায়াতের ব্যবস্থা গ্রহণে কিছু পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”

এন এইচ, ২১ অক্টোবর

Back to top button