বৃটেনে এ মাসেই মুক্ত জীবনের আশা দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন
মুখে মাস্ক আর লাগবে না, সামাজিক দূরত্বও আর মেনে চলতে হবে না- এই মাসেই ইংল্যান্ডে এমন মুক্ত জীবনযাপনের আশা দেখালেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আগামী ১৯ জুলাই ইংল্যান্ডে কোভিড-১৯ মহামারীর সব ধরনের বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন বলে বিবিসি ও রয়টার্স জানিয়েছে।
সিদ্ধান্ত নিলেও চূড়ান্ত ঘোষণা আগামী ১২ জুলাই সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জনসন।
টিকার উপর ভর করে জনসন মহামারী ঠেকানোর সব বাধা সরিয়ে ফেলার এমন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও করোনাভাইরাসের ডেল্টা সংক্রমণের দাপটের মধ্যে তা আগেভাগে হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে সতর্ক করেছেন।
এমনকি জনসনের সঙ্গে থাকা ইংল্যান্ডের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা অধ্যাপক ক্রিস হুইট বলেছেন, তিনি মাস্ক পরা ছাড়বেন না।
২০১৯ সালের শেষে নতুন করোনাভাইরাস চীন থেকে ছড়িয়ে বিশ্বে মহামারী বাঁধিয়ে দেওয়ার পর গত বছর এই সময়ে ইংল্যান্ডে ছিল চরম বিপর্যয়কর অবস্থা।
মহামারী নিয়ন্ত্রণে অন্য সব দেশের মতো ইংল্যান্ডকেও মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, অতিথি নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিধি-নিষেধ আনতে হয়। ফলে মানুষের জীবনযাপন, চলাচল গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
বছর গড়িয়ে যুক্তরাজ্যসহ ইংল্যান্ডে পরিস্থিতির বেশ উন্নতিই হয়েছে বলা চলে; যদিও ভারতে উদ্ভূত করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরন সংক্রমণ আবার বাড়িয়ে তুলেছে।
সোমবারও যুক্তরাজ্যজুড়ে ২৭ হাজার ৩৩৪ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, নয় জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৭৪ জন।
এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার রোডম্যাপ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন।
তিনি যে রূপরেখা দিয়েছেন, তাতে ১৯ জুলাইয়ে বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়ার পর জনসমাগমস্থলে কেউ ভদ্রতাবশত মাস্ক পরতে পারবেন, তবে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
সামাজিক দূরত্ব মানার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হলে এক ঘরে ছয়জনের বেশি মানুষ আবার থাকতে পারবে।
বিয়ে কিংবা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান স্বাভাবিক সময়ের মতোই করা যাবে। যে কোনো অনুষ্ঠান সীমিত সংখ্যক অতিথি নিয়ে আয়োজনের বাধ্যবাধকতাও থাকবে না। কেয়ার হোমে কাউকে দেখতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ থাকবে না।
তাহলে দেড় বছর পর ইংল্যান্ডের বারগুলো আবার মুখর হবে। গণপরিবহণেও কঠোর বিধি-নিষেধগুলো আর থাকবে না।
মহামারীকালে নানা বিধি-নিষেধ আরোপে স্থানীয় প্রশাসনে ক্ষমতাও বাতিল হবে। স্কুল পরিচালনা, ভ্রমণ, আইসোলেশন নিয়েও নতুন পরিকল্পনা আসবে।
কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে টিকার সনদ কিংবা কোভিড পরীক্ষা করিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান তার মতো করে এই সংক্রান্ত নিয়ম করতে পারবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
মুক্ত জীবনের আশার সুর শোনানোর পাশাপাশি সতর্কবার্তাও দিচ্ছেন বরিস জনসন।
এই মাসের শেষ দিকে দৈনিক সংক্রমণ ৫০ হাজারে পৌঁছতে পারে, আর তাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।
তবে ব্যাপক হারে টিকাদানের সাফল্যের দিকটি মনে করিয়ে তিনি বলেছেন, “এখন যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে কখন করব?”
রয়টার্স লিখেছে, টিকা গ্রহণের পর থেকে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য। সোমবার পর্যন্ত ৮৬ শতাংশ প্রথম ডোজ ও ৬৪ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজ টিকা গ্রহণ করেছে।
জনসন বলেছেন, ৪০ বছরের নিচের ব্যক্তিদের ১২ সপ্তাহ নয়, ৮ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হবে। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিদের মত একই নীতি অনুসরণ করা হবে।
তার মতে, গ্রীষ্মের এই সময়ে যখন ভাইরাস অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তখন যদি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া না যায়, সামনে শীত থাকায় তাহলে আবার আগামী বছর অবধিও ঘরবন্দি হয়ে কাটাতে হবে।
ব্রিটিশ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ বলেছেন, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার রূপরেখা তিনি মঙ্গলবার পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে তুলে ধরবেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা শোনার পর লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার বিবিসিকে বলেছেন, যখন সংক্রমণের গতি ঊধর্বমুখী, তখন একদিনেই সব বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়া হবে খেয়ালী সিদ্ধান্ত।
এই ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বুঝে ভারসাম্য রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। গণপরিবহন ও জনসমাগমস্থলে মাস্ক পরা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন লেবার নেতা।
ইংল্যান্ডের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ক্রিস হুইটি বলছেন, সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন তিনিও মাস্ক পরে যাওয়ার পক্ষপাতি।
ঘরের মধ্যে অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকলে, কোনো কর্তৃপক্ষ নিয়ম করলে কিংবা পাশে থাকা অন্যদের অস্বস্তি দূর করার জন্য হলেও তিনি মাস্ক পরবেন বলে জানান।
বিবিসি লিখেছে, বরিস জনসন যেভাবে বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়ার পথে এগোচ্ছেন, এমনটা বিশ্বে কোনো দেশই করছে না।
যুক্তরাজ্যেও ইংল্যান্ডের মতো পথে কেউ হাঁটছে না। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস, উত্তর আয়ারল্যান্ড বলেছে, তারা তাদের কোভিড নীতি নিয়েই এগোবে।
স্কটল্যান্ড সরকার আগামী ৯ অগাস্টের পর বিধি-নিষেধ শিথিলের কথা ভাবলেও মাস্ক বাধ্যতামূলকই থাকবে। ওয়েলস বলছে, করোনাভাইরাসের সঙ্গে থেকে জনসাধারণকে জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, ইংল্যান্ডে বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়ার জন্য অন্তত শরৎকালটা দেখে নেওয়া যেত। আর প্রাপ্তবয়স্ক সবাইকে টিকা দেওয়ার পরই কেবল এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ।
বিধি-নিষেধ তুলে নিলে এই গ্রীষ্মে আবার যেভাবে সবখানে ভিড় জমবে, তা সংক্রমণ আবার বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।
সুত্রঃ বিডিনিউজ২৪.কম