চট্টগ্রাম

করোনাকালেও এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ

চট্টগ্রাম, ০৫ জুলাই – করোনার সঙ্কটকালেও এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রামের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। দিনরাত চলছে এ প্রকল্পের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে। এটি চালু হলে শহর থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছানো যাবে মাত্র ২০ মিনিটে। নগরজীবনে আসবে গতি। ২০২৩ সালের মধ্যেই চালু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)।

কিন্তু এর টাইগারপাস প্রান্ত নিয়ে আপত্তি সিটি কর্পোরেশন এবং নগরবিদদের একটি অংশের। উড়াল সড়কের কারণে শহরের সবচেয়ে নান্দনিক এই অংশটি ঢাকা পড়ে যাবে, এমনই অভিমত তাদের। তবে ওই এলাকাটিও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আওতায় না আনলে সুফল পুরোপুরি মিলবে না বলে অভিমত প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চউকের।

চউক সূত্রে জানা যায়, ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ের মোট পিলার হবে ৩৮৯টি, যার মধ্যে ২৩০টির কাজ শেষ হয়ে আগ্রাবাদ চৌমুহনী পর্যন্ত চলে এসেছে। পতেঙ্গা থেকে কাঠগড় পর্যন্ত এলাকায় গার্ডার এবং স্থাব বসে গেছে। বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা পর্যন্ত এলাকার এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের যে আপত্তি ছিল, সেটিরও সুরাহা হয়ে গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই ৬ একর জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছে।

বারিক বিল্ডিং থেকে নিমতলা পর্যন্ত এলাকায় বিদ্যমান সড়কের বাইরে দিয়ে উড়াল সড়ক হওয়ার কথা ছিল বন্দরের নিরাপত্তা বিবেচনায়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরনো সড়কের ওপর দিয়েই যাবে এক্সপ্রেসওয়ে। ফলে সড়কের পাশে মাত্র ১০ থেকে ১২ ফুট জায়গা নিতে হবে। এতেকরে ভবন ও স্থাপনা ভাঙতে হবে কম। নকশা পরিবর্তনে ব্যয় কিছু বাড়লেও তা এখনও পুরোপুরি নিরূপিত হয়নি।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পের অধীনে ৯টি জংশনে ২৪টি র‍্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) নির্মাণের কথা রয়েছে। এর মধ্যে নগরীর লালখানবাজার থেকে শুরু হওয়া প্রায় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়েতে টাইগারপাসে ৪টি, আগ্রাবাদে ৪টি, বারিক বিল্ডিং মোড়ে দুটি, নিমতলা মোড়ে ২টি, কাস্টমস মোড়ে ২টি, সিইপিজেডে ৪টি, কেপিজেডে ২টি, কাঠগড়ে ২টি ও পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এলাকায় ২টি র‍্যাম্প থাকবে। চারলেনের এই এক্সপ্রেসওয়ের প্রশস্ততা হবে ৫৪ ফুট। এ ছাড়াও এক্সপ্রেসওয়েতে থাকবে আড়াই হাজার এলইডি লাইট।

জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হচ্ছে নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কের ওপর দিয়ে। দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এ কাজ এগিয়ে আসছে উত্তরের দিকে, যা এসে থামবে লালখান বাজার এলাকায়। টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার চট্টগ্রামের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন স্থান হওয়ায় এ অংশটুকু উন্মুক্ত রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন নগরবিদদের কেউ কেউ। সে অনুযায়ী পতেঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হওয়ার কথা ছিল টাইগারপাসের দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ প্রান্ত থেকে। কিন্তু সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা এসে মিলছে লালখান বাজার এলাকায় আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কতৃপক্ষের কর্তৃক বাস্তবায়নধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের লালখানবাজার অংশে ফ্লাইওভার নির্মাণ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে চসিক।

গত ২১ জুন আপত্তি জানিয়ে সিডিএ চেয়্যারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ। তবে চিঠি পাঠানোর প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেলেও চসিকের আপত্তির জবাবে কোনো উত্তর দেয়নি সিডিএ। এমন অবস্থায় চসিকের প্রকৌশলীরা বলছেন— চলমান কঠোর বিধিনিষেধ কেটে গেলে চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে বিষয়টি জানানো হবে। এতে সেবা সংস্থাগুলোর সাথে বসে এর একটি সুরাহা করবে।

চসিকের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজ্জামেল হক স্বাক্ষরিত আপত্তিপত্রে লেখা হয়েছে, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসেওয়ে প্রকল্পের অধীনে লালখান বাজার ফ্লাইওভার নির্মাণ হলে লালখান বাজারের সড়কের দৃষ্টিনন্দন পাহাড় দু’টির সৌন্দার্য মলিন হবে। সেখানে ফ্লাইওভার নির্মাণ না করে সমতলে সড়কটি সংযুক্ত করার প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।’

এ নিয়ে গত ৮ জুন সিডিএ ও চসিকের সমন্বয়ে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, পাহাড়ের সৌন্দর্য অক্ষুণ্ণ রেখে এবং পাহাড় না কেটে কিভাবে লালখানবাজার থেকে টাইগারপাস অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা যায়। পরে ২১ জুন সিডিএ’কে লিখিত আপত্তিপত্র দেয় চসিক।

কিন্তু চউকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চসিকের আপত্তির বিষয়টি অযৌক্তিক। তাছাড়া ওই অংশে ফ্লাইএভারের সংযোগ স্থাপন গ্রাউন্ড লেভেলে করার যে প্রস্তাব চসিক দিয়েছে, তা পুরোপুরি অপরিকল্পিত। বরং ওই এলাকায় পাহাড় বিনষ্টের ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে বলে মত চউক কর্মকর্তাদের। এ বিভ্রান্তি কাটাতে একটি এনিমেশন তৈরির কথা ভাবছে চউক। সেখানে দেখানো হবে সড়কের মাঝ অংশের প্রায় ৩০ ফুট উপরে ফ্লাইওভার করা হলে দু’পাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপর এবং নিচ থেকে অবলোকন করা সম্ভব হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হবে বিরতিহীন যান চলাচলকে প্রাধান্য দিয়ে। তাই এ ধরনের পরিকল্পনা করার আগে সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। এ প্রকল্পের বারেক বিল্ডিং থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত বেশ কিছু বাধা আছে। এখানে দেওয়ান হাটের ওভারপাস ও ব্রিজ আছে। এছাড়াও পাহাড় আছে। সব কিছুর উপর দিয়ে ফ্লাইওভার করলে পরবর্তীতে আর আকাশ দেখা দেখা যাবে না।’

পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘উন্নয়নের সাথে পরিবেশের একটা সাংঘর্ষিকতা থাকে। তবে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশের সাথে সাংঘর্ষিকতাকে কমিয়ে আনতে হয়। যারা এ পরিকল্পনাগুলো করেন তারা আসলে চট্টগ্রামের নান্দনিকতাকে ধারণ করেন না। ধারণ করলে এ ধরনের জটিলতাগুলো খুব সহজে সমাধান করা যেতো।’

এ বিষয়ে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা আপত্তি দিয়েছি। ফোরাম ফর প্ল্যান চিটাগং-ও একই আপত্তির কথা জানিয়েছে। কিন্তু চউকের পক্ষ থেকে জবাব পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে মেয়র মহোদয়ের সাথে আলাপ করবো। উনি হয়তো সবার সাথে বসতে পারেন। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত তো নেয়া যায় না।

এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক চউকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত করে এই উড়াল সড়ক প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন। আমরা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এমনভাবে কাজ করছি যাতে করে টাইগারপাস থেকে লালখান বাজার এলাকার সৌন্দর্য্য আরও ফুটে ওঠে।

তিনি বলেন, টাইগারপাস নিয়ে একটা আবেগ থাকতেই পারে, যেমনটি আমাদেরও আছে। কিন্তু পরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থার স্বার্থে ওই স্থানটিকেও উড়াল সড়কের আওতায় আনতেই হচ্ছে।

আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তারা বলছেন পাহাড় দেখা যাবে না। আমরা পাহাড় উন্মুক্ত রেখে কাজ করব। এখন চসিকের যদি এ বিষয়ে আপত্তি থাকে তাহলে সেটা উধর্ধতন কতৃপক্ষ দেখবে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে অত্যন্ত নান্দনিক নকশা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হচ্ছে। এর জন্য কোনো পাহাড় কাটতে হবে না। সৌন্দর্য্য নষ্টের প্রশ্নই ওঠে না, বরং এলাকাটি যেন আরও উদ্ভাসিত হয় সেভাবেই হবে এই উড়াল সড়ক।

তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে যদি লালখান বাজার পর্যন্ত না এনে টাইগারপাসের দেওয়ানহাট প্রান্তে থামিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেখান থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত এলাকায় প্রতিদিনই যানজট সৃষ্টি হবে। এতে এক্সপ্রেসওয়ের শতভাগ সফল পাওয়া যাবে না। সে কারণেই চারলেনের মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে র‍্যাম্প আকারে দুটি অংশ লালখান বাজারে নামবে, অপর দুই অংশ সরাসরি যুক্ত হবে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে।

‘সাড়ে ৬ কি.মি. দীর্ঘ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে মিলে গেলে ১৬ কি.মি. দৈর্ঘ্যরে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাবে সাড়ে ২২ কিলোমিটার। বিদ্যমান সড়কে যানজট কমবে এবং নগরবাসী এর সুফল পাবে। সেইসঙ্গে বর্তমানে লালখান বাজার, দেওয়ান হাট, টাইগারপাস থেকে বিভিন্ন গাড়ির স্বাভাবিক চাপ থাকবে। আর সমতলে ফ্লাইওভারের সংযোগ করতে হলে পাহাড়ও কাটতে হবে। সবকিছু মিলিয়ে আমরা আগামী ৫০ বছরের চিন্তা ভাবনা মাথায় রেখে এগুচ্ছি।’

প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, এই প্রকল্পের কাজ ২৪ ঘণ্টাই চলছে। এভাবে কাজ চললে আগামী দেড় বছরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে পারবো আশা করছি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম বলেন, ‘প্রকল্পটির গুরুত্ব ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় চট্টগ্রামে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। চট্টগ্রামবাসীর জন্য এ প্রকল্পটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিমানবন্দর থেকে শহরে পৌঁছাতে ইপিজেড, কাস্টমস, দেওয়ানহাট প্রভৃতি এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের কারণে বিলম্ব হয়ে যায়। এই ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজ শেষ হলে মাত্র ১৫-২০ মিনিটেই কোনো যানজট ছাড়া শহরে পৌঁছানো যাবে। লালখান বাজার থেকে টাইগার পাস পর্যন্ত পাহাড়ের সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে বিশেষজ্ঞ সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে কাজ করা হচ্ছে, যাতে এক্সপ্রেসওয়ে এই ফ্লাইওভারের ওপরে দাঁড়িয়ে পর্যটকরা আশপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। লালখানবাজার থেকে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ফ্লাইওভারের মাধ্যমে অল্প সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর, আগ্রাবাদ, কাস্টমস, ইপিজেড এবং বিমানবন্দরে যাতায়াত সম্ভব হবে।’

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম নগরীর যানজট নিরসনে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। অনুমোদনের দেড় বছর পর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পটির পিলার পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন। তখন ২০২০ সালের মধ্যেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে তিন কিলোমিটার অংশের অ্যালাইনমেন্ট নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে জটিলতা তৈরি হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটির নির্মাণকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মেসার্স ম্যাক্স-র্যানকেন জয়েন্ট ভেনচার।

তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ জার্নাল
এস সি/০৫ জুলাই

Back to top button