জাতীয়

সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইনে যা থাকছে

এমরান হোসাইন শেখ

ঢাকা, ০২ জুলাই – আগামীকাল সংসদে উঠছে জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন-২০২১। সামরিক সরকারের আমলে জারি হওয়া এ সংক্রান্ত Delimitation of Constituencies Ordinance, 1976 রদ করতে এই আইনটি আসছে। দেশের সব আইন বাংলায় প্রণয়নের নির্দেশনা এবং সংসদের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষেই মূলত নতুন করে আইনটি আনা হচ্ছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিদ্যমান আইনের ব্যাপক যোগ-বিয়োগ করে আইনটির প্রস্তাব করলে সরকার তা আমলে নেয়নি। কেবল আইনটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদসহ সামান্য কিছু পরিবর্তন আসছে এই আইনে।

শনিবার (৩ জুলাই) একাদশ জাতীয় সংশোধনের ১৩তম অধিবেশনের সমাপনী দিনে সংসদ কাজে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আইনটি সংসদে তুলবেন। সংসদীয় কমিটির রিপোর্টের পর এটি পরবর্তী অধিবেশনে পাস হতে পারে।

এদিকে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করে বিদ্যমান আইনগুলোর ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েও তা হালে পানি পায়নি। গেলো একাদশ জাতীয় সংসদের আগে জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইনটি সংস্কারের ঘোষণা দিলেও সেটা সম্ভব হয়নি। পরে বিদ্যমান আইনেই তারা সীমানা পুনর্বিন্যাস করে ওই নির্বাচন সম্পন্ন করে।

পরে ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে পাঠায় ইসি। ইসি তার খসড়ায় বিদ্যমান জনসংখ্যা কোটার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের সঙ্গে সঙ্গে ভোটার সংখ্যা ‍যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন, বড় বড় শহরের ও পল্লি এলাকার ভারসাম্য রক্ষার কথাও বলা হয় তাদের প্রস্তাবে। ইসির খসড়া আইনে জনসংখ্যার কোটা নামে একটি উপধারাও যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, ইসির বেশিরভাগ নতুন প্রস্তাবে ভেটো দেয় আইন মন্ত্রণালয়। পরে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে নির্বাচন কমিশন আইনটি কয়েক দফায় সংযোজন-বিয়োজন করে চূড়ান্ত করে। এতে দেখা যায়, বিদ্যমান আইনের বিধানগুলোর প্রায় পুরোটাই রয়েছে গেছে।

বিদ্যমান আইন ও শনিবার সংসদে উত্থাপনের জন্য নির্ধারিত বিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদ্যমান আইনের ৮টি ধারার স্থলে নতুন আইনে ৯টি ধারার প্রস্তাব থাকছে। নতুন ধারাটিতে আইনের অধীনে বিধি প্রণয়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে বিধি প্রণয়নের সুযোগ নেই।

বিদ্যমান আইনের ধারা-১-এ একটি নতুন উপধারার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেখানে আইনটি ‘অবিলম্বে কার্যকর হবে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনের ৮ নম্বর ধারায় একটি উপধারা যুক্ত করে ‘দৈবদুর্বিপাকে বা অন্য কোনও কারণে আঞ্চলিক সীমানা নির্ধারণ করা না গেলে বিদ্যমান সীমানার আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

যা থাকছে নতুন আইনে

আইনের ধারা-১-এর উপধারা-১-এ শিরোনাম; উপধারা-২-এ আইন কার্যকরের সময়, ধারা-২-এ সংজ্ঞা; ধারা-৩-এ কমিশনের কার্যপদ্ধতি; ধারা-৪-এ ক্ষমতা অর্পণ; ধারা ৫-এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণে কমিশনকে সহায়তা প্রদান; ধারা-৬-এ আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সংখ্যক সংসদ সদস্য নির্বাচিত করতে পুরো দেশকে উক্ত সংখ্যক একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকায় বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখা এবং আদমশুমারির ভিত্তিতে যতদূর সম্ভব বাস্তবভিত্তিক বণ্টনের কথা বলা হয়েছে।

নতুন আইনের ধারা-৬-এর ৪ উপধারায় খসড়া নির্বাচনি এলাকার তালিকার আপত্তি, পরামর্শ শুনানি করে চূড়ান্ত তালিকার গেজেট প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে।

আইনের ৭ ধারায় ইসির সীমানা নির্ধারণটির বিষয় নিয়ে দেশের কোনও আদালত বা অন্য কোনও কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলে বিধান রয়েছে। এই বিধানটি বিদ্যমান আইনে হুবহু একই রয়েছে।

আইনের ধারা-৮ এ নতুন করে আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান বিধানের মত প্রত্যেক আদমশুমারির পরে বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ‘দৈবদুর্বিপাক বা অন্য কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণে সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে সর্বশেষ নির্ধারিত সীমানার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে উপধারা যুক্ত হয়েছে। অবশ্য ১৯৯০ সালের আলাদা একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই ধরনের বিধানটি বিদ্যমান আইনেও রয়েছে। ধারা-৮-এর ৩ উপধারায় ১৯৯০ সালের অধ্যাদেশের বিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে, আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকাসমূহের আয়তন, অবস্থান, ইত্যাদি হুবহু ঠিক রেখে কেবল প্রশাসনিক পরিবর্তন থাকলে সেটা অন্তর্ভুক্ত করে আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকাসমূহের তালিকা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করার বিধান করা হয়েছে।

আইনের ৯ নম্বর নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে। যেখানে আইনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে কমিশনের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতার বিধান থাকছে।

যা বললেন আইনমন্ত্রী

উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে সামরিক ফরমান দ্বারা জারিকৃত Delimitation of Constituencics Ordinance, 1976-এর কার্যকরতা লোপ পায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বার্থে আবশ্যক বিবেচনায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জারিকৃত কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১৩ দ্বারা অন্যান্য কতিপয় অধ্যাদেশের সঙ্গে এই অর্ডিন্যান্স’কেও কার্যকর রাখা হয়। পরে সরকার সামরিক শাসনামলে জারিকৃত অধ্যাদেশগুলো সব স্টেকহোল্ডার এবং সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে বাংলায় নতুন আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্ডিন্যান্সটির প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে তা রহিত করে সংশোধনসহ পুনঃপ্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত বিলটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
এতে মন্ত্রী আরও বলেন, প্রস্তাবিত বিলে সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সংখ্যক একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, নির্বাচন কমিশনের কার্যপদ্ধতি, ক্ষমতা অর্পণ ও কমিশনকে সহায়তা প্রদান এবং কমিশন কর্তৃক বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি আইনে পরিণত হলে জাতীয় সংসদের একক আঞ্চলিক নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করা সম্ভব হবে মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন।

কেন এই আইন

সংবিধান ও সীমানা নির্ধারণ আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংবিধানের ১১৯(গ) অনুচ্ছেদে ইসিকে সংসদে নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। ১২৪ অনুচ্ছেদে ইসিকে ‘সংসদ আইনের দ্বারা নির্বাচনি এলাকার সীমা নির্ধারণ’ করার কথা বলা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ‘সংসদ নির্বাচন এলাকা সীমানা নির্ধারণ বিধান অধ্যাদেশ, ১৯৭৬’ জারি করা হয়। এরপর থেকেই এই অধ্যাদেশের বলে সংসদ নির্বাচনের সীমানা পুনর্বিন্যাস হয়ে আসছে। নতুন আইন হলে এর বিধানে এসব কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এম এউ, ০২ জুলাই

Back to top button