শিক্ষা

গৌরবের ১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেকাল-একাল

পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য ও আসিফুর রহমান

ঢাকা, ০১ জুলাই – ১৯ মার্চ ১৯৪৮। সদ্য গঠিত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে প্রথমবার এলেন, যখন ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের এই অংশে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

সফর শুরুর পাঁচ দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় স্পষ্ট করেই বললেন, ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।’

কিন্তু, উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তার এই বক্তব্য ভালোভাবে নিলেন না। সমাবেশস্থলে ‘না’ ‘না’ ধ্বনি উঠল। প্রতিবাদের মুখে অপ্রস্তুত জিন্নাহ কয়েক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে যান।

রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার শুরু থেকেই। বাংলার পক্ষে জনমত গড়তে ততদিনে গড়ে উঠেছে তমদ্দুন মজলিশ। প্রচার, প্রচারণাসহ বিভিন্ন উপায়ে সে দাবি জানানো হচ্ছে। সেদিনের পর থেকে বাঙালি পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা মিছিল-মিটিং শুরু করেন, কেন বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হবে না—এ বিতর্কে।

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু হয় ১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অবস্থান নেন। তাদের এই ঘোষণায় পূর্ব বাংলা উত্তাল হয়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে সরকার গণজমায়েত ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেট) সামনে ২১ ফেব্রুয়ারি সেই নিষেধাজ্ঞা ভাঙেন।

পুলিশের গুলিতে সালাম-রফিক-বরকত-জব্বার শহীদ হলে আন্দোলন বড় আকার ধারণ করে।

সেই যে শুরু, এর পর থেকে যেকোনো গণতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে ‘চালিকাশক্তি’ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থান ছিল বরাবরই সামনের সারিতে।

এরপর ১৯৬২-এর শিক্ষানীতি-বিরোধী গণআন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান শেষে আন্দোলনকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া— সবকটি ঘটনায় তৎকালীন শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ইতিহাসবিদদের লেখার পরতে পরতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রনেতা হিসেবে তোফায়েল আহমেদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রাশেদ খান মেনন, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব, মতিয়া চৌধুরী, নূরে আলম সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো নেতাদের জন্ম দেয়, যারা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

এমনকি দেশ স্বাধীনের পরেও স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল চালকের আসনে।

এরপরও ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করার পর এক বছরের মধ্যেই ছাত্র সমাজের বিরোধিতা এই সরকারের ভিতে আঘাত হেনেছিল। আইয়ুববিরোধী সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মতোই ছাত্রসংগঠনগুলোর একটি সম্মিলিত ফোরাম গঠন করা ছিল আন্দোলনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার আগ পর্যন্ত ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের শতবর্ষ পর সেইসব সোনালি দিনগুলো যেন কেবলই অতীত। এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলে ছাত্রসংগঠনগুলো গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিপরীতে, ছাত্রনেতাদের একটি বড় অংশ আর্থিক ও রাজনৈতিক মুনাফার দিকে ধাবিত হন। এমনকি কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন ও মাদক চোরাকারবারের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদরা বলছেন, ১৯৯০ সালে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন আসার পর থেকে ছাত্ররাজনীতি সেই ঐতিহ্যের ধারা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি দলগুলো সবসময় ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করেছে।

ফলে, তখন থেকেই ছাত্র নেতৃত্বের গুরুত্ব ও মান নিচের দিকে নামতে থাকে।

সংবাদ মাধ্যমের দিকে তাকালেও বর্তমান ছাত্রনেতাদের কর্মকাণ্ডের একটা ধারণা পাওয়া যায়। গত দুই বছরের সংবাদপত্রগুলোর শিরোনামে ছাত্ররাজনীতি উঠে এসেছে বেশিরভাগ সময় দলগুলোর অন্তর্কলহে।

বিপরীতে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত না আসা পর্যন্ত কেউ কোনো অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে না।

সাবেক ছাত্রনেতারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অধীনতা বরণ করে নেওয়ার পর থেকে ছাত্ররাজনীতি পথচ্যুত হয়েছে।

তারা বলছেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাত্র সংগঠনের স্বকীয়তাকে নষ্ট করে দেয়। ছাত্র নেতৃত্বে চিন্তা-চেতনা-মেধার গুরুত্ব কমতে থাকে আর অছাত্রদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: নতুন যুগের সন্ধানে’ শীর্ষক বইতে লিখেছেন, ছাত্ররাজনীতি এখন টাকাপয়সা ও ক্ষমতা দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, স্বাধীনতার আগে যা ছিল দেশপ্রেম আর আদর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত।

তিনি বলেন, এরশাদ-বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময়ই ছিল স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির সুবর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ পর্যায়।

‘১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রসংগঠনগুলোর ঐক্য অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশ নির্বাচিত সরকারের অধীনে শাসিত হয়ে আসছে। হয় আওয়ামী লীগ জোট অথবা বিএনপি জোট এসব সরকারের নেতৃত্বে ছিল। এর প্রতিটি পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছড়ি ঘুরায়।’— আনু মুহাম্মদের পর্যবেক্ষণ।

মাঝখানে তিনি অবশ্য দুই বছরের একটা ছেদের কথা বলেছেন, ওই সময়েও সামরিক শাসনবিরোধী বিক্ষোভে জড়িয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৭ সালের ২০-২২ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে সেনাসদস্যদের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

নব্বইয়ের এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের পর ছাত্ররাজনীতি কেন পথচ্যুত হয়েছে, জানতে প্রতিবেদক যোগাযোগ করে সাবেক ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূরে আলম সিদ্দিকী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শান্তনু মজুমদারের সঙ্গে।

তারা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠনে পরিণত হওয়াই এই পথচ্যুতির অন্যতম প্রধান কারণ।

ছাত্র সংগঠনকে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে না রাখার জন্যে ২০০৮ সালে আরপিওতে যে সংশোধন আনা হয়েছিল, সেটা কোনো দলই মানে না। সেখানে বলা হয়েছিল, কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবে না।

দলগুলো এর পরে তাদের গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের অঙ্গসংগঠনের তালিকা থেকে ছাত্র সংগঠন দুটিকে বাদ দেয়। বিপরীতে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগকে উল্লেখ করে ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ সংগঠন হিসেবে, বিএনপি ছাত্রদলকে বলে ‘স্বকীয় সহযোগী সংগঠন’। কিন্তু, ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকে নিজেদের সাংগঠনিক নেত্রী বলে উল্লেখ করে এবং ছাত্রদলের কমিটি গঠন করে বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (১৯৭০-৭২) নূরে আলম সিদ্দিকী ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতির যে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা ছিল, তখনকার যারা রাজনীতি ও ছাত্ররাজনীতির অগ্রভাগে ছিলেন, তারা বিশ্বাস করতেন ছাত্ররাজনীতি মূল রাজনীতির পথনির্দেশক। পরবর্তীকালে ছাত্ররাজনীতি দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হয় ও তার স্বকীয়তা, সার্বভৌমত্ব, মন ও মননশীলতা অনেকখানি হারিয়ে ফেলে।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘তখন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিকদের প্রাধান্য ছিল। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সততা, দেশপ্রেম, আদর্শ—এগুলো ছিল মূল স্রোতধারা। রুগ্নতা থাকলেও সেটা কোনো সময় ছাত্র সমাজের ভেতরে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান প্রবণতা হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু, বর্তমানে দেশের সামগ্রিক রাজনীতি হয়ে উঠেছে দূষিত ও ‍রুগ্ন। সামগ্রিক সেই অবক্ষয়ের প্রতিফলন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সুস্থ ও দেশপ্রেমিক ধারায় পরিচালিত হয়েছে, তখন ছাত্র আন্দোলন তার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিকশিত হয়েছে। ওই সময়টাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পারফরমেন্সটাও ছিল খুব উচ্চমানের। ছাত্র আন্দোলনের অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় অ্যাকাডেমিক পারফরমেন্সও নিচের দিকে নেমে গেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আগের আমলের যে জমাট ছাত্ররাজনীতি, সেটার প্রসপেক্ট আমি আর দেখি না। এর প্রথম কারণ হচ্ছে, সামরিক শাসনের মতো একটি কমন এনিমি না থাকা। তা ছাড়া, নির্বাচিত সরকারের লেজিটিমেসি ক্রাইসিস নেই। আর তৃতীয় কারণ হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের এখন রাজনীতির বাইরেও টেকনোলজি, স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের মতো আগ্রহের অনেকগুলো উপাদান রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বামপন্থি ধারার ছাত্রসংগঠনগুলোর দুর্বলতা এই সময়টাতে বড় কোনো আন্দোলন সৃষ্টি করতে দেয়নি। ৭০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত বামপন্থিদের একটা সমর্থন ছিল, তারা একটা স্ট্যান্ড বা পজিশন নিতে পারত। কিন্তু, পরবর্তীতে সেটা আর থাকেনি।’

সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার
এন এইচ, ০১ জুলাই

Back to top button