লকডাউনে রংপুরের গ্রামে মানুষের বাড়তি চাপ
রংপুর, ০১ জুলাই- করোনা দুর্যোগে কঠোর লকডাউনের খবরে রংপুরের গ্রামাঞ্চলে বাড়তি চাপ পড়েছে। তার ওপর সামনে কোরবানির ঈদ। ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছেন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত স্বল্প আয়ের মানুষজন। এতে ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে সাত দিনের কঠোর লকডাউনে নিম্নআয়ের মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে রংপুর জেলা প্রশাসন।
করোনার থাবায় এমনিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছেন গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কর্মহীন হয়ে পড়া এসব মানুষের সঞ্চয় ইতোমধ্যে ফুরিয়ে এসেছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজের নানা স্তরে। মানুষের মনে এক ধরণের অস্থিরতা বিরাজ করছে, ভর করছে এক অজানা শঙ্কা। তার ওপর কর্ম হারিয়ে বিশাল অঙ্কের জনগোষ্ঠি গ্রামে যুক্ত হওয়ায় পড়ছে কাজের আকাল। অভাব-অনটনে পড়ে অনেকেই জীবিকার তাগিদে অসৎ পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
রংপুরের সবচেয়ে অভাবী এলাকা হিসেবে পরিচিত গঙ্গাচড়া। এলাকায় কাজ না থাকায় এখানকার তিস্তার ভাঙনে সর্বশান্ত হওয়া পরিবারের প্রধানরা আয়ের সন্ধানে বছরের বেশিরভাগ সময় থাকতেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে তারা কৃষি শ্রমিক ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করাসহ কেউ রিকশা চালাতেন, কেউবা কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। কিন্তু বর্তমান করোনাকালে সেখানে কারোরই আর কাজ মিলছে না। উপরন্তু কাজ-চাকরি হারিয়ে বাধ্য হয়ে তারা ফিরে এসেছেন বেকারত্বের এলাকা নিজ গ্রামে।
ঢাকার শাহবাগে একটি ছোট্ট গার্মেন্টস এ কাজ করতেন তিস্তার চরের শোয়েব আলী। করোনায় ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘কয় বছর থাকি ওইখানে চাকরি করি কোনমতে সংসার চলছিল। এ্যালা বাড়িত বসি আছি, কোন কাম (কাজ) নাই। বউ-ছাওয়া নিয়া খুব কষ্টে আছি।’ তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী এলাকার জবেদা খাতুন (৪২) ঢাকায় একটি বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। করোনা আতঙ্কে বাড়িওয়ালা তাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়ায় নিজ এলাকায় ফিরে এসেছেন। স্বামী পরিত্যক্ত এবং ভিটেমাটিহীন এই নারী এক সন্তান নিয়ে এখন দিশেহারা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, সন্তানকে নিয়ে অন্যের জমিতে ছোট্ট একটি ঘর করে আছেন তিনি। করোনাকালে এলাকাতেও কেউ আর কাজে নিতে চায় না। এখন অনেক কষ্টে দিন কাটছে তার।
গঙ্গাচড়ার লক্ষ্মীটারী ইউনয়নের চরগ্রাম জয়রামওঝা। এখানকার ইউপি সদস্য দুলাল মিয়া জানান, এই চরে ৮০০ পরিবারের বাস। জীবিকার তাগিদে ৬০০ পরিবারের প্রধানই বছরের বেশিরভাগ সময় কাজের সন্ধানে ছুটে যান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কাজ না থাকায় বর্তমানে তারা সবাই বাড়িতে ফিরে এসেছেন। বেকার হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকেই।
উন্নয়ন গবেষকরা বলছেন, করোনাক্রান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করা রংপুর বিভাগের আট জেলায় দুই লক্ষাধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এসব মানুষ এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এতে দেশের মানচিত্রে উত্তরাঞ্চলে নতুন করে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। শহর থেকে কর্ম হারিয়ে গ্রামে ফিরে আসা মানুষদের নতুন করে কর্মসংস্থানের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে কর্মহীনদের মাঝে হতাশাসহ বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা।
রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এখন সরকারি কর্মচারি ছাড়া কেউ ভালো নেই। গবেষণা বলছে, প্রায় দুই কোটি মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে এসেছেন। এর আগে দেশে চার কোটি মানুষ অসহায় ছিল। বিশেষ করে কর্ম হারিয়ে পিছিয়ে পড়া রংপুরে দুই লক্ষাধিক মানুষ ফিরে আসার বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক। কর্মহীন মানুষদের মূল স্রোতধারায় আনতে না পারলে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রে বড় ক্ষতি হবে। সেজন্য কৃষিনির্ভর এই এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করে গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন তিনি।
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, করোনা সংক্রমণ যে হারে বেড়েছে তাতে কঠোর লকডাউনের বিকল্প কিছু নেই। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ এই লকডাউনে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে প্রশাসন। কঠোর বিধি নিষেধের সময় হতদরিদ্ররা যাতে খাদ্য সংকটে না পড়ে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ