জাতীয়

বাংলাদেশে কালো টাকার সঠিক পরিমাণ কত?

গোলাম মওলা

ঢাকা, ৩০ জুন – আবারও ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঢালাওভাবে সুযোগ দেওয়ার বিরোধিতা করলেও দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমাণে কালো টাকা সাদা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কী পরিমাণ কালো বা অপ্রদর্শিত অর্থ বাংলাদেশের মানুষের হাতে রয়েছে, তার কোনও প্রকৃত হিসাব নেই। এনবিআরের এক হিসাব বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর গত এক বছরেই সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির করা ‘অদৃশ্য অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে কালো টাকা ওঠানামা করে।

অবশ্য সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে)। যদিও বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কাউকে সেখানে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুইস ব্যাংকের এই টাকার সবই অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা। এর অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে সেখানে গেছে।

কালো টাকা সাদা করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার পরও নগদ টাকা, শেয়ার বাজার, জমি-ফ্ল্যাটে কালো টাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে।

অর্থাৎ, ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে গত অর্থবছরের মতো ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে নয়। এবার কালো টাকা সাদা করতে হলে ২৫ শতাংশ কর এবং ওই করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে।

নগদ টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্র কিনেও টাকা সাদা করা যাবে। একইভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে চাইলে একই হারে কর ও জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। জমি ও ফ্ল্যাট কিনে এলাকা ও আয়তন ভেদে নির্ধারিত কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবে।

আগামী ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এ সুযোগ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা দিয়ে নতুন শিল্পকারখানা করা যাবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ১০ শতাংশ কর দিয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কালো টাকা সাদা করার বিদ্যমান সুযোগটিও অব্যাহত আছে। কালো টাকা সাদা করলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ছাড়া অন্য কোনও সংস্থাও প্রশ্ন করবে না।

মঙ্গলবার (২৯ জুন) জাতীয় সংসদে ২০২১ সালের অর্থবিল পাসের সময় কিছু ধারা সংশোধন করে পাস করা হয়েছে। সেখানে নগদ টাকা, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে রাখা টাকার পাশাপাশি শেয়ার বাজার, ফ্ল্যাট-জমিতে বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কর ও জরিমানা দিয়ে আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এ জন্য অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে একাধিক ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।

এনবিআরের তথ্যমতে, গত এক বছর ধরে নগদ টাকা সাদা করায় বেশি আগ্রহ ছিল করদাতাদের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৩৪ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেছেন। সব মিলিয়ে গত এক বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। গত জুলাই থেকে চলকি বছরের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৩৪১ জন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন।

এদিকে কালো টাকার প্রকৃত পরিমাণ জানা না গেলেও গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণামূলক ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ নামের গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘দেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে কালো টাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। মোটা অঙ্কের এই অর্থ একই সময়ের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ।’ আবুল বারকাতের মতে, ‘সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সৃষ্টি হয়েছে আয়কর, মুনাফার ওপর কর এবং মূলধন কর ফাঁকির মাধ্যমে।’

কালো টাকা সৃষ্টির উৎস উল্লেখ করে ওই বইয়ে বলা হয়েছে, ‘সবচেয়ে বেশি হয়েছে আয়কর, মুনাফার ওপর কর এবং মূলধন কর ফাঁকি থেকে। মোট কালো টাকার মধ্যে এই তিন খাত থেকে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ এসেছে। এরপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকি থেকে কালো টাকা হয়েছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ঘুষ থেকে কালো টাকা হয়েছে ১২ শতাংশ। এভাবে চোরাচালান থেকে এসেছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি থেকে এসেছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অন্যান্য অবৈধ খাত থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আমদানি শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে এসেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কালো টাকা।

ড. আবুল বারকাত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কালো টাকা সৃষ্টির উৎসগুলো বন্ধ করা উচিত।’ কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দিয়ে কালো টাকা উদ্ধার করে ঘাটতি বাজেট পূরণ করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর কালোটাকার পরিমাণ বেড়েছে। এই বইতে দেখানো হয়েছে— ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ বছরে কালো টাকা হয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে কালো টাকা হয়েছে ১৮ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ১৯৭৩-৭৪ এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছরই কালো টাকার পরিমাণ বেড়েছে।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এন এইচ, ৩০ জুন

Back to top button