শিক্ষা

অস্তিত্বের লড়াইয়ে দেশের ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন

ঝর্ণা রায়

ঢাকা, ২৮ জুন – শহরের অলিগলিতে বের হলেই দেখা মিলতো নানান আলপনার দেয়াল। জানালার ফাঁক গলিয়ে চোখের দৃষ্টি ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যেত ফুলের মতো শিশুদের ছোটাছুটি। দেয়ালে আঁকা প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে খেলছে তারা আপন মনে। নতুন নতুন বন্ধুদের নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখর করে রাখতো আশপাশের এলাকা। শহরের পাশাপাশি উন্নত গ্রামগুলোতেও দেখা যেত এই চিত্র। শিশুদের প্রথমবারের মতো ঘরের বাইরে আসার অভিজ্ঞতা, বর্ণমালা শেখা কিংবা ফুলপাখির সঙ্গে পরিচিত করে দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব পালন করা এসব প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় কিন্ডারগার্টেন। প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের তোপে যা আজ অস্তিত্ব সংকটে।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে দেড় বছর ধরে বন্ধ দেশের সকল শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ এই সময়ে অন্যান্য বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থে পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। ইতোমধ্যেই সারাদেশে ১০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, নিজেদের অর্থে চলে কিন্ডারগার্টেন। শিক্ষার্থীদের ফি থেকেই মূলত যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। পরীক্ষার সময়গুলোতে প্রায় ৭০ ভাগ শিক্ষার্থী তাদের বকেয়া ফি দিয়ে থাকে। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিন্ডারগার্টেনগুলো পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর নবীনগর হাউজিং এর ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড হাই স্কুলের পরিচালক তকবির আহমেদ জানান, করোনায় কিন্ডারগার্টেন বন্ধ থাকায় এরইমধ্যে কয়েক লাখ টাকা ঋণগ্রস্ত হয়েছেন। সামনে আর এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না। তাই ১৭ বছর ধরে চালিয়ে নেওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি বিক্রির নোটিশ ঝুঁলিয়েছেন।

সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে ৬০ হাজারের মতো কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। এ সকল কিন্ডারগার্টেন দেশের এক কোটি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে আসছে। এদের প্রায় ৮০ শতাংশ ভবন ভাড়া করে পরিচালনা করা হয়। এখান থেকে পাওয়া বেতনের ওপর নির্ভর করে ১০ লাখ শিক্ষক-শিক্ষিকার জীবন জীবিকা। কোনো রকমে প্রথম কয়েকমাস পার করলেও শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনভাতা, ভবন ভাড়া পরিশোধে ব্যর্থ অনেক কিন্ডারগার্টেন কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বেসরকারি প্রাথমিক কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক সমিতির মহাসচিব শেখ মিজানুর রহমান বলেন, অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। শিক্ষকদের বেতনভাতা তো দূরের কথা, বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত কিন্ডারগার্টেন অর্ধেক বন্ধ হয়ে যাবে। যারা নিজ বাড়িতে তারা হয়তো টিকে থাকবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রণোদনার আবেদন করেছি। কোনো সাড়া পাইনি। আমরা এটাও বলেছি স্কুলগুলো খুলে দেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা পরিচালনা করবো। একেক ব্যাচে একেক ক্লাস করে পরিচালনা করবো। আমাদের কথা কেউ শোনে না। সামান্য সুদে ঋণের কথা বলেছি। এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেন না।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের জরিপ অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলোর ৬০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছে।

জরিপ সূত্রে জানা গেছে, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে না পেরে মানসিক চাপে আত্মহত্যা করেছেন দুইজন প্রধান শিক্ষক। তারা হলেন- কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার প্যারাগন কিন্ডারগার্টেনের রওশন কবীর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আলোকান্দি বিদ্যাপিটের আব্দুল খালেক আত্মহত্যা করেছেন।

অনেক শিক্ষক ইতোমধ্যেই পেশার পরিবর্তন করেছেন। এমনই একজন রোজ গার্ডেন হাই স্কুল সাবেক শিক্ষক ফারজানা আক্তার বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। করোনা বাধ্য করেছে শখের পেশা, প্রিয় কাজের জায়গা এবং সহকর্মীদের ছেড়ে যেতে। বর্তমানে আমি কাজ করছি ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত দাফন কার্যক্রমে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। এখন অনলাইন ক্লাসের নামে শিশুদের মোবাইলে আসক্ত করে ফেলছে। লেখাপড়া থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। অটোপাসের যে কলঙ্ক মাথায় নিয়েছে তা এক সময় ভয়াবহ রূপ ধারন করবে।

তিনি বলেন, আমরা বারবার বলেছি অন্তত একটা রোটেশন করে হলেও বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক। এখন অ্যাসাইনমেন্টের জন্য শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে পারে। এতে তো ঝুঁকি আরও বেশি হচ্ছে। আমরা চরম বেকায়দার মধ্যে আছি। বাংলাদেশে ৬০ হাজার কিন্টারগার্টেন ১ কোটি শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতো।

তিনি জানান, ১০ লাখ শিক্ষক-শিক্ষিকা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা চিঠি দিয়েছি শিক্ষার্থীরা যেন স্কুলগুলোতে বেতনটা অন্তত দেয়। শিক্ষকেরা অনলাইন ক্লাস নেবেন। শিক্ষার্থীরা অন্য ফি না দিক শুধু বেতনটা যেন দেয়। অনেক স্কুল মোটামুটি ভাল রয়েছে। তবে কিছু স্কুল রয়েছে খুব দুর্বল যারা আগে থেকেই দুর্বল ছিল। তাদের খুব সমস্যা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকে।

সূত্র : সারাবাংলা
এন এইচ, ২৮ জুন

Back to top button