ঢাকা, ২০ অক্টোবর- অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধান আমেরিকা ও থাইল্যান্ড থেকে দেশে ক্যাসিনো সামগ্রী নিয়ে আসেন। তার হাত ধরে দেশে অনলাইনে ক্যাসিনো ব্যবসা বেশ জমে ওঠে। জুয়ার সামগ্রী আনতে দেশ থেকে ১৩ কোটি টাকা পাচার করেন তিনি।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সেলিম প্রধান ধরা পড়েন। অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে দুদকও তার বিরুদ্ধে তদন্তে মাঠে নামে। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সেলিম প্রধানের মালিকানায় থাইল্যান্ডে প্রধান গ্লোবাল ট্রেডিং, এশিয়া ইউনাইটেড এন্টারটেন্ট মেন্টলি, তমা হোম পাতায়া কোং লিমিটেডসহ সাতটি কোম্পানির সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পাওয়া গেছে। এর আগে সেলিম প্রধানের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজ্যান্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরের মাধ্যমে এমএলএআর পাঠায় দুদক।
সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করছেন দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান। এর আগে তিনি আদালতে আবেদনের ভিত্তিতে সেলিম প্রধানের ১২ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজ করেন।
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি নারায়ণগঞ্জে জন্মগ্রহণ করলেও বেড়ে উঠেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে। বড় ভাই জাপানে থাকার সুবাধে ২০ বছর বয়সে পাড়ি জমান জাপানে। সেখানে ৯ বছর থাকার পর ব্যবসায়িক ঝামেলার কারণে তাকে জাপান ছাড়তে হয়। এরপর পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেখানেও বেশিদিন থাকা হয়নি তার। চার বছর পর আবারও জাপানে ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু পারিবারিক ঝামেলায় পড়ে আবারও তাকে জাপান ছাড়তে হয়। এরপর তিনি বসতি গড়েন থাইল্যান্ডে। রাশিয়ান এক মেয়েকে বিয়ে করে ব্যবসা ও সংসার শুরু করেন।
থাইল্যান্ডে থাকলেও মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ আসতেন। ২০১২ সালের পর দেশে ক্যাসিনো জুয়ার ব্যবসা শুরু করেন অনলাইনে। কোরিয়ান ব্যবসায়িক পার্টনার করে রীতিমতো গুলশানে অফিস নিয়ে শুরু করেন অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ার অনেক প্রমাণ এখন দুদকের হাতে।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক চক্রের সাথে মিশে ‘শিশু পর্নোগ্রাফি বানানো’ বোরহান
সেলিম প্রধান সংঘবদ্ধভাবে ক্যাসিনো খেলা পরিচালনা করতেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। P24-‰ aming, T-21 Innovation, S-7 Entertainment ছিল তার অনলাইন বেটিং সাইট (টাকার বিনিময়ে অনলাইনে জুয়া খেলা)। P24-‰ aming এর অনলাইন বেটিং সাইটের ওয়েব অ্যাড্রেস হচ্ছে www.P24-Gaming.com. দেশে সেলিম প্রধানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চক্রটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি) সরকারি-বেসরকারি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর নাম-পরিচয় ব্যবহার করে প্রচার চালাত।
তারা বিভিন্ন ভিডিওতে জুয়া ও গেম খেলার নিয়ম, পদ্ধতি এবং বিভিন্ন প্রলোভনমূলক কথাবার্তা বলে এই সাইটে বিভিন্ন পেশার লোকজনকে অনুপ্রাণিত করত। মূলত অনলাইন বেটিংয়ের অন্তরালে এটা একটা জুয়ার আসর। যে কোনো ব্রাউজার দিয়ে www.P24-Gaming.com.‰ Enter করলে এদের হোম পেজ আসে। হোম পেজে মেন্যু বারও রয়েছে। মেন্যু বারগুলো হচ্ছে- খরাব, Sports, Casino, Live Casino, Poker, Free Games ইত্যাদি। খরাব- এই অপশনে বর্তমানে যে খেলা চলমান তাতে বেটিং করা হয়।
Sports-এ বিভিন্ন স্পোর্টসের (ক্রিকেট, ফুটবল, বাস্কেটবল, বেসবল, আমেরিকান বেসবল ইত্যাদি) ওপর বেটিং করা হয়। এছাড়া পরের গেমেও বেটিং করা হয়। Casino- এখানে বিভিন্ন অনলাইন গেমে বেটিং করা হয় এবং উপার্জিত অর্থ গ্যাম্বলিংয়ের মাধ্যমে দ্বিগুণ/চারগুণ করা যায়। Live Casino- এই অপশনে অনেক টাইপের লাইভ ক্যাসিনো থাকে।
যাতে বেটিং করা হয় এবং উপার্জিত অর্থ গ্যাম্বলিংয়ের মাধ্যমে দ্বিগুণ/চারগুণ করা যায়। Poker- এই সাইটের একটি জনপ্রিয় গেম। Free Games- এই মেন্যুতে ২০০টিরও বেশি ফ্রি গেম আছে, যা অল্পকিছু টাকার বিনিময়ে খেলা যায় এবং গ্যাম্বলিংয়ের মাধ্যমে দ্বিগুণ/চারগুণ করা যায়। এই সাইটের জনপ্রিয় কিছু খেলা হচ্ছে: Caribbean beach poker, American gold poker, Joker explosion, Double bonus poker, Joker poker king, Casino roulette, Gold roulette, Black jack, Black jack multi hand, Aces and English, European roulette, Jack or better. তারা এই সাইটকে কোরিয়ান স্বনামধন্য ও বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন সাইট হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্যবসাটি পরিচালনা করে আসছিল।
এছাড়া আনলাইনে এই গেম খেলতে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। রেজিস্ট্রেশন করতে একজন ব্যবহারকারীকে কিছু তথ্য দিতে হয়। সেগুলো হচ্ছে: User name, Valid email, Password, Country, B.D.T. রেজিস্ট্রেশন করার পর অটোমেটিক এই সাইটে একটি প্রোফাইল তৈরি হয়ে যায়। কোনো ব্যবহারকারী চাইলে তার প্রোফাইলে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তা আপডেট করতে পারেন।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমে সেলিম প্রধান প্রায় ১৩ কোটি টাকা উপার্জন করেন। সেই টাকা তিনি দেশেও রাখেননি। পাচার করে দেন থাইল্যন্ডে। এছাড়া থাইল্যান্ডে তার পরিচালনাধীন গ্লোবাল ট্রেডিং, এশিয়া ইউনাইটেড এন্টারটেন্ট মেন্টলি, তমা হোম পাতায়া কোং লিমিটেড নামের সাতটি কোম্পানির রেকর্ডপত্র এখন দুদকের হাতে।
থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংক, দ্য সায়েম কমার্শিয়াল ব্যাংকে সেলিম প্রধানের ২০ কোটির টাকার বেশি অবৈধ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে তিনি কয়েক কোটি টাকা দিয়ে ইউএসএ’র লাস ভেগাস, নেভাদা থেকে ক্যাসিনো চিপস ও অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট ক্রয় করেন।
তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান ইতোমধ্যে সেলিম প্রধানের অর্ধশত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছেন এবং তার আয়কর নথিসহ সব স্থাবর সম্পদ জব্দ করেছেন। থাইল্যান্ডের সেলিম প্রধানের ব্যাংক হিসাব ও কোম্পানির রেকর্ডপত্র জব্দের জন্য এমএলএআর করেছে দুদক। সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ তদারক করছেন দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
সূত্র : যুগান্তর
এন এইচ, ২০ অক্টোবর