মেক্সিকো

মুক্তি মেলেনি মেক্সিকোয় বন্দি ৩৯১ বাংলাদেশীর

তাসনিম মহসিন

মেক্সিকো সিটি, ১১ জানুয়ারি- যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে অবৈধভাবে মেক্সিকোয় ঢুকে প্রায়ই আটক হচ্ছেন কোনো না কোনো বাংলাদেশী। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মেক্সিকোর কারাগারে বন্দিদের মধ্যে ৩৯১ জনকে ফিরিয়ে আনার জন্য গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছিল দেশটি। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এখনো এসব বন্দির নাগরিকত্ব যাচাইয়ের কাজ শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। ছয় মাস ধরে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালিতেই আটকে আছে তাদের নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া।

জানা গেছে, মেক্সিকোর কারাগারে বন্দি ৩৯১ বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনতে ২০১৭ সালের ২০ জুন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় দেশটি। এরপর তাদের নাগরিকত্ব যাচাই করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে একজন প্রতিনিধি চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফিরতি চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরে সেই চিঠিটি প্রত্যাহার করে আবারো চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বাতিল করার জন্য বলা হয়।

প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি চেয়ে পরে তা আবার বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, যেহেতু মেক্সিকোয় একটি প্রতিনিধি দলকে যেতেই হবে, এ কারণে সেখানে একটি পাসপোর্ট ও ভিসা উইং স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে স্বরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দল মেক্সিকো যাবে। সেই দলই এসব বাংলাদেশীর নাগরিকত্ব যাচাই করে আসবে। এজন্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি না নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মেক্সিকোয় বন্দিদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে প্রতিনিধি দল প্রস্তুত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেরি করায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজস্ব প্রতিনিধি দল গঠনের জন্য একটি নোট অনুমোদন করে। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, পুলিশের বিশেষ শাখার প্রতিনিধিসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যদের রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তবে রহস্যজনকভাবে ওই দলটিরও মেক্সিকো গমন আটকে গেছে। এরপর আবারো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিনিধি চেয়ে জরুরি চিঠি পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মূলত কর্মকর্তাদের মধ্যে রেষারেষি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাসপোর্ট ও ভিসা উইং স্থাপনের পরিকল্পনায় পুরো বিষয়টি আটকে রয়েছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, এটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়। এদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে দ্রুত একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো উচিত। কারণ যারা বর্তমানে আটক অবস্থায় রয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই মানব পাচারের শিকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন লিবিয়া থেকে বাংলাদেশীদের ফেরত নিয়ে আসে, তখন কোনো ঝামেলা হয়নি। পুরো কাজটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একা করেছে। সেখানে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) সঙ্গে নেয়া হয়েছিল। মেক্সিকোর বন্দিদের ক্ষেত্রেও আইওএমকে সংশ্লিষ্ট পক্ষ করার চিন্তা করা হয়েছিল। এটি হলে কাউকেই যেতে হবে না, আইওএমই সবাইকে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে প্রক্রিয়াও থামিয়ে দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় মেক্সিকোর ভূখণ্ড থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আটক হয়েছেন কয়েক হাজার বাংলাদেশী। বর্তমানে তারা মেক্সিকোর বিভিন্ন কারাগারে আটক অবস্থায় রয়েছেন।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মাইগ্রেশন, মেক্সিকো (আইএনএম) এবং ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ১৪৯, ২০১২ সালে ১৬৭, ২০১৩ সালে ৩২৮, ২০১৪ সালে ৬৯০, ২০১৫ সালে ৬৪৮, ২০১৬ সালে ৬৯৭ এবং ২০১৭ সালে ১২০ জন বাংলাদেশী অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মেক্সিকোয় আটক হন। তারা বর্তমানে দেশটির কারাগারে বন্দি আছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের আগে কয়েকটি দেশ হয়ে মেক্সিকোয় প্রবেশ করেন বাংলাদেশীরা। কখনো কখনো ১০ থেকে ১২টি দেশ পেরিয়ে সেখানে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। মানব পাচারের রুট হিসেবে প্রথমে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে দুবাই, ইস্তাম্বুল অথবা তেহরান যান বাংলাদেশীরা। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া অথবা স্প্যানিশ গায়ানা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা।

আবার অনেক সময় ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, গায়ানা ও বলিভিয়া থেকে দুর্গম পথে যাত্রা করে কলম্বিয়া-পানামা-কোস্টারিকা-নিকারাগুয়া-এল সালভাদর-গুয়াতেমালা হয়ে মেক্সিকো পৌঁছে দেয়া হয় বাংলাদেশী আশ্রয়প্রার্থীদের। পরবর্তী সময়ে মেক্সিকো থেকে সুযোগ বুঝে সীমানা অতিক্রম করে স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন তারা। এজন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে দায়িত্বে থাকেন মানব পাচারে যুক্ত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। খরচ হিসেবে জনপ্রতি ২৫-৩০ হাজার ডলার পর্যন্ত নেয় পাচারকারী চক্র।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গল পথ বেছে নেয়। কারণ এসব স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম। তবে দুর্গম এসব পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন। মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকায় মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী ১৯৯০ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত প্রায় ছয় হাজারেরও বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছেন। তবে এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশী, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।

এমএ/ ০৪:০০/ ১১ জানুয়ারি

Back to top button