ঢাকা, ১৯ অক্টোবর- বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রার ১৫ বছর পর আবাসিক হলের অপেক্ষা ঘুচছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের; কিছু দিনের মধ্যেই ১৬তলা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের দরজা খুলছে বিশ্ববিদ্যায়টির ছাত্রীদের জন্যে।
পুরান ঢাকার এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মঙ্গলবার নতুন ওই হলের উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান। তবে সেখানে ছাত্রীদের উঠতে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে কয়েক মিনিটের হাঁটা পথে লিয়াকত এভিনিউয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ১৬তলা এই আবাসিক ভবন।
হলটি নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনের সাব অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার শাহাদাৎ হোসেন জানিয়েছেন, হলের কাজ ‘৯৯ শতাংশ’ শেষ হলেও এখনও থাকার মতো পরিস্থিতি হয়নি।
“কনস্ট্রাকশনের কাজ শেষ। তোষক ও বালিশ ছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সব আসবাবেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ পেলে পুরা বিল্ডিংয়ের লাইট-ফ্যান চলবে। এছাড়া ফায়ারের কাজ ৮৫ শতাংশ সম্পন্ন, ওদের শুধু দুটো পাম্প বসানো বাকি। লিফটের কাজ ২০ ভাগ কমপ্লিট হয়েছে। এই মাসের মধ্যেই তা পুরোপুরি শেষ হবে।”
মাস দুয়েকের মধ্যেই হলটি পুরোপুরি ছাত্রীদের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে বলে আশা করছেন তিনি।
শুরুতে এই হলের নির্মাণ ব্যয় ৩৩ কোটি টাকা ধরা হলেও কাজ শেষ করতে ৩৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান শাহাদৎ হোসেন।
তিনি বলেন, ১৬তলা হলটির ১৫৬টি কক্ষে চারজন করে মোট ৬২৪ জন ছাত্রী থাকতে পারবেন। হলের তৃতীয় থেকে ১৬তলা পর্যন্ত ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আর নিচতলা ও দোতলায় করা হয়েছে ক্যান্টিন।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটলে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে হলে ছাত্রীদের তোলা হবে বলে উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান জানিয়েছেন।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে সিট বরাদ্দ হয়, সে নীতিমালাগুলো পর্যালোচনা করে একটা নীতিমালা তৈরি করেছেন হলের প্রভোস্ট; সে অনুযায়ী ছাত্রীরা হলে উঠবে।”
এই হলে ৬২৪ জন ছাত্রী উঠতে পারবেন, সেক্ষেত্রে আরও কত সংখ্যক ছাত্রীকে বাইরেই থাকতে হবে সেই পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী ওহিদুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, “আমাদের মোট ২০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে আনুমানিক ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ছাত্রী আছে।”
যেভাবে এলো প্রথম হল
দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কলেজ থাকাকালে পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি ছাত্রাবাস থাকলেও পরে তা বেদখল হয়ে যায়।
২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই বেদখল হল পুনরুদ্ধার ও নতুন হল নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন।
পরে ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ৩/১ লিয়াকত এভিনিউয়ের পরিত্যক্ত জায়গাটি দখল করে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হলের ব্যানার টাঙিয়ে দেয়।
এক বছর পর ২০১৩ সালের ২৫ অগাস্ট শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বৈঠকে সেখানে এক হাজার ছাত্রীর জন্য ২০তলা দুটি টাওয়ার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।
পরে ওই বছরের ২২ অক্টোবর তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৬তলা হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এরইমধ্যে ২০১৪ সালে শিক্ষার্থীরা হলের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুললে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প’র অধীনে ওই বছরের ২০ অক্টোবর হলটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়।
পরে কাজের ধীরগতির কারণে ছাত্রাবাসটির নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ কয়েক দফা বাড়াতে হয়েছিল।
এদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হল প্রস্তুত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা উচ্ছ্বসিত হলেও আরও হলের দাবি জানিয়েছেন তারা।
ছাত্রাবাস না থাকায় বিভিন্ন মেসে শিক্ষার্থীদের ‘মানবেতর’ জীবনযাপন করতে হচ্ছে জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মনীষা আক্তার বলেন, “অবশেষে আমাদের এত দিনের কষ্ট লাঘব হচ্ছে। আশা করি, মহামারীর পর ভার্সিটি খুললেই হলে উঠতে পারব।”
ছাত্রদের জন্যও দ্রুত হল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়ে ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের মানোয়ার হোসেন বলেন, “এত বছর পর মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে, এটা খুবই ভালো ব্যাপার। কারণ বাইরে তাদের অনেক নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয়।
“কিন্তু ২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১৫ বছরে একটি মাত্র হল হল, এটা হতাশার। আরও হল প্রয়োজন আমাদের। অথচ আর কোনো হলের উদ্যোগ নেই।”
আরেক শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, “দূর থেকে যে কষ্ট করে এসে ক্লাস করতে হয়, যারা করে তারাই বুঝে। সেখানে একটা হলের কেবল নির্মাণ কাজ শেষ হতেই লেগেছে সাত বছর। আশা করি, সরকার দ্রুত ছাত্রদের জন্য অন্তত আরেকটি হলের ব্যবস্থা করবে, না হলে হল ছাড়াই ছাত্রদের ক্যাম্পাস ছাড়তে হবে।”
হল উদ্বোধনের খবরে উচ্ছ্বসিত জগন্নাথের সাবেক শিক্ষার্থীরাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম ব্যাচের শিক্ষার্থী রশিদ আল রুহানী বলেন, “আমাদের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ দিন হলের জন্য আন্দোলন করেছে। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে হল জুটেনি। তবে জুনিয়ররা হলে থাকতে পারবে, এটাও আমাদের জন্য আনন্দের। দেশের একমাত্র অনাবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমাটা আমরা কাটাতে পারলাম। এখন দ্রুত আরও কিছু হল নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরাণীগঞ্জে হল নির্মাণের ঘোষণা বেশ কয়েকবার এসেছে।
সে বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ওহিদুজ্জামান বলেন, “কেরাণীগঞ্জে মাস্টারপ্ল্যানের কাজ চলছে। সেখানে ১৬টা হল হবে। হলগুলোর কাজ কবে শুরু হবে তা এখন বলা মুশকিল। মাস্টারপ্ল্যান হবে, তারপর এগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দ হবে।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা
ব্রাহ্ম ধমের্র সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের জানাতে আরমানিটোলায় ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব প্রাঙ্গণে ১৮৫৮ সালে চালু হয় অবৈতনিক ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল। আর্থিক সঙ্কটে ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয় বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে, পরে জমিদারের বাবার নামে যা ‘জগন্নাথ স্কুল’ নাম পায়।
এরপর উপমহাদেশের পুরাতন বিদ্যাপীঠটির দেড় শতকের পথচলা চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের বর্তমান ঠিকানায়।
আরও পড়ুন: দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে: দোরাইস্বামী
১৮৮৪ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বিতীয় ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। ১৮৮৭ সালে ‘কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল’ নামে স্কুল শাখাকে জগন্নাথ কলেজ থেকে আলাদা করা হয়, যা এখন কে এল জুবিলি স্কুল নামে পরিচিত।
১৯২০ সালে ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ‘জগন্নাথ কলেজ আইন’ পাস করে। তবে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত শিক্ষা সীমিত করা হয়।
১৯৪২ সালে মেয়েরাও জগন্নাথ কলেজে ভর্তির সুযোগ পায়। পরে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ দিতে জগন্নাথ কলেজে প্রথম নৈশকালীন পাঠদান শুরু হয়।
১৯৬৮ সালে জগন্নাথকে সরকারি (প্রাদেশিকীকরণ) করা হয়, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফায় এর বিরোধিতা করলে ওই বছরই কলেজটি আগের অবস্থায় ফিরে যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জগন্নাথ কলেজকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে উন্নীত করা হয়।
২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।
করোনাভাইরাসের কারণে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতা হবে স্বল্প পরিসরে। ছাত্রী হলের উদ্বোধনের পর ভার্চুয়ালি আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সীমিত থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের আয়োজন।
সূত্র: বিডিনিউজ
আর/০৮:১৪/১৯ অক্টোবর