অপরাধ

সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীরা যে কারণে মামলা করতে চান না

রিয়াদ তালুকদার

ঢাকা, ১৭ জুন – নবদম্পতি হানিমুনে গিয়েছিলেন কক্সবাজার। সেখানে হোটেলে নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কয়েকটি ছবি তুলে গুগল ড্রাইভে রেখেছিলেন স্বামী। অফিসের কাজে সাইবার ক্যাফেতে গেলে মেইল পাঠানোর পর লগআউট করতে ভুলে যান। পরে অন্য একজন ছবিগুলো দেখে সেগুলো ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে ওই স্বামী-স্ত্রীকে। এরপরও থানায় অভিযোগ করতে রাজি হননি ওই দম্পতি।

অন্য আরেক ঘটনায় জানা যায়, মিঠুনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে নদীর (ছদ্মনাম) বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সম্পর্ক হয়। একপর্যায়ে শারীরিক সম্পর্কেও জড়ান তারা। কিছুদিন পর হয়ে যায় ছাড়াছাড়ি। এরপর মেয়েটির দাবি অনুযায়ী, ছেলেটি প্রায়ই তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আসছে। সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হলেও মামলা করতে রাজি নন নদী।

পূর্বপরিচয় বা সম্পর্কের জেরে বা অন্য কোনওভাবে পাওয়া ছবি কিংবা ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো, কারও ছবি বা পরিচয় ব্যবহার করে ফেক আইডি খুলে অপপ্রচার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন লিংক বা অ্যাপ ব্যবহার করে পাসওয়ার্ড চুরি করে টাকা আদায়; এসবই এখন সাইবার জগতের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যক্তির অসচেতনতার সুযোগ নিয়েই অপরাধীরা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে।

অন্যদিকে পরিবার ও আত্মীয়দের কথা ভেবে অনেকেই আইনগত ব্যবস্থা নিতে রাজি থাকেন না। এ ছাড়া আইনি প্রক্রিয়ায় গেলে বেশ ‘ঝুট-ঝামেলা’ পোহাতে হবে, ভিকটিমের এমন চিন্তার কারণেও এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সাইবার জগৎ আমরা প্রতিনিয়ত মনিটরিং করছি। ভুক্তভোগীদের প্রতিটি অভিযোগ আমলে নিয়ে অপরাধীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে। তবে ভিকটিম নিজেই যখন আইনগত ব্যবস্থা নিতে চান না, তখন কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আমাদের।

সাইবার জগতে নারী কিংবা শিশুদের এ ধরনের সমস্যা সমাধানে পুলিশ সদর দফতরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর চালু হয় Police cyber support for women ইউনিট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজ, হটলাইন নম্বর ও ইমেইলের মাধ্যমে হয়রানির শিকার নারী ও শিশুরা সাইবার সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা অবহিত করছে পুলিশকে। অভিযোগের তালিকায় আছে-ফেক আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইল হ্যারাসমেন্ট, অশ্লীল কনটেন্ট পাঠানো, অশালীন প্রস্তাব ইত্যাদি।

ফেক আইডির অভিযোগ বেশি

পুলিশ সদরদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মোট অভিযোগের ২৮ দশমিক ২৯ শতাংশ ফেক আইডি সম্পর্কিত হয়রানির। ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ আইডি হ্যাকিং সমস্যা নিয়ে। ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ ব্ল্যাকমেইলিং ও মোবাইলে হ্যারাসমেন্টের শিকার ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ইনবক্সে অশ্লীল কনটেন্ট পাঠানো সংক্রান্ত অভিযোগ প্রায় ৫ ভাগ। এ ছাড়া অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে সাইবার জগতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন ২৩.৯৬ ভাগ অভিযোগকারী।

পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ইউনিটের এআইজি মো. আবু তৌহিদ বলেন, ‘সচেতনতার অভাবেই সাইবার অপরাধ ঘটছে বেশি। সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে মানুষ এখনও সেভাবে অভিজ্ঞতা পায়নি। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা এর শিকার হচ্ছে বেশি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অপরিচিতদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হচ্ছে। পরে দেখা-সাক্ষাতের ছবি, ভিডিওসহ বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে বিপদে পড়ছে তারা।’

তিনি বলেন, ‘সাইবার ক্রাইমের আওতায় যেসব অপরাধ হচ্ছে, সেগুলো প্রথাগত অপরাধের মতো নয়। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হলেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনেকেই আগ্রহ দেখান না। ভুক্তভোগীকে অন্তত সাধারণ ডায়রি কিংবা মামলা করতে হবে। তা না হলে আমাদেরও আইনানুগ প্রক্রিয়ায় যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে অনেক সময় অভিযুক্তকে ডেকে এনে মধ্যস্থতার মাধ্যমেও সমাধানের চেষ্টা করি। ভিকটিমদের জানাই, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের আগে যতদূর সম্ভব পরিচয় নিশ্চিত হয়ে নেওয়া উচিৎ।’ সেইসঙ্গে কিছুতেই ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও শেয়ার না করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা।

সাইবার ক্রাইমের পরিসংখ্যা

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার জগতে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ৯২ দশমিক ২৯ শতাংশই নারী। ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন বেশি। যা মোট ভুক্তভোগীর ৫৬ দশমিক ৪৯ ভাগ। ১৮ বছরের নিচে শিশুরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে আবার ৩০ বছরের বেশি বয়সী ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা বেশি। সাইবার হয়রানিতে এগিয়ে আছে ঢাকা বিভাগ। ৩৩ দশমিক ১২ শতাংশ অপরাধ ঘটছে এখানে।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট কাজী মুস্তাফিজ বলেন, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে কিশোর বয়স থেকেই বাবা-মায়ের সন্তানদের যথাযথ খোঁজখবর রাখতে হবে। সন্তানদের ছোটবেলা থেকে প্রযুক্তির বিপদ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

শুধু সচেতন থাকলেই সাইবার অপরাধ ৫০ ভাগ কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। কাজী মুস্তাফিজ আরও বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘সাইবার ক্রাইম মূলত তিন ধরনের-ব্যক্তিগত, রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৩ ভাগ মানুষই কোনও না কোনোভাবে সাইবার হামলার শিকার। ২০১৯ ও ২০২০ সালে যে পরিমাণ মামলা দায়ের হয়েছে তার তথ্য বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। অসচেতনতামূলক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে শুরু করে বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপনে পা দিয়ে বিপদে পড়ে অনেকে। এ ছাড়া বিত্তশালী অনেকেই বিভিন্ন ক্লাবে যাওয়া-আসা করেন, তাদের মধ্যেও অনেক অযাচিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছেন অনেক পুরুষ।’

তানভীর জোহা আরও বলেন, ‘ফিজিক্যাল ও ডিজিটাল লাইফ দুটি আলাদা সত্ত্বা। দুটোকে আলাদা রাখতে হবে। আবেগতাড়িত হয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ছবি সংরক্ষণ করায় ভবিষ্যতে সাইবার অপরাধের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় থেকে যাচ্ছেন অনেকে। এ অপরাধ কমাতে তিনটি বিষয় বেশি প্রয়োজন- কাউন্সেলিং, এমপাথি তথা সহমর্মিতা ও অ্যাকশন। ভুক্তভোগী কারও ছবি যদি প্রকাশ হয়েও যায় তিনি যেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ভুল কোনও সিদ্ধান্ত না নেন সেই জন্য কাউন্সেলিং ও সহমর্মিতা খুবই জরুরি।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
এম ইউ/১৭ জুন ২০২১

Back to top button