যমুনার বুকে কংক্রিটের সড়ক
সিরাজগঞ্জ, ০৭ জুন – বর্ষাকালে প্রমত্তা যমুনা পূর্ণ যৌবনের উন্মাদনায় দু’পারের কূল ছাপিয়ে ওঠে। নিজের প্রশস্ত বুকে আশ্রিত লক্ষপ্রাণের অস্তিত্ব ভুলে মনের আনন্দে দোলে এ নদী।
সাগর সমান পানিতে ভাসতে থাকে গ্রামের পর গ্রাম।
বর্ষা যায়, আসে শরৎ ও হেমন্ত। নববধূর মতো নীরব যমুনা তখন ফুলে-ফসলে সজ্জিত হতে থাকে। বসন্তে প্রকৃতি যখন ফিরে পায় নবযৌবন, সংকুচিত হয় যমুনা। বুকে তার জেগে ওঠে শত শত বালুচর।
ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আভির্ভূত বহুরূপী যমুনাকে আঁকড়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর চিরায়ত কষ্টের কারণ ছিল দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্ষা মৌসুমে নৌকায় চলাচল করতে পারলেও শুস্ক মৌসুমে কষ্টের যেন সীমা থাকত না। মালপত্র পরিবহনের জন্য ঘোড়া বা গরুর গাড়ি ব্যবহার করা গেলেও উত্তপ্ত বালুচরে হেঁটেই চলতে হতো চরাঞ্চলবাসীকে।
তবে এখন দিন পাল্টে গেছে। যমুনার বুক চিরে নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের সড়ক, বদলে গেছে চরের মানুষের জীবনমান। বালুচরের বুকে গড়ে ওঠা পাকা সড়কের কল্যাণে নতুন দিনের সন্ধান পেয়েছেন সিরাজগঞ্জের চরাঞ্চলবাসী।
সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া, তেকানি, নিশ্চিন্তপুর, সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়নে গিয়ে চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নের চিত্র দেখা যায়। যমুনা গর্ভস্থ এসব ইউনিয়নের মানুষের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা যেন শহরের মতোই।
নৌকায় করে কাজিপুর সদর থেকে নাটুয়ারপাড়া ঘাটে পৌঁছার আগেই দূর থেকে দেখা যায় লম্বা একটি কংক্রিটের সড়ক। দীর্ঘ চরের বুক চিরে দূরের কোনো গাঁয়ে প্রবেশ করেছে দারুন সুন্দর সড়কটি। রাস্তায় চলছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, শ্যালো ইঞ্জিন চালিত তিন চাকার বেশ কিছু যানবাহন। এছাড়া রয়েছে যাত্রীবাহী মোটরসাইকেল।
কিছু দূর যাবার পর দেখা যায়, বিশাল বাজার। নাটুয়ারপাড়া নামে এ জনপদটি যেন যমুনার বুকে গড়ে ওঠা এক চিলতে শহর। নাটুয়ারপাড়া স্বাধীনতা চত্বর (গুলমোড় বাজার) থেকে দু’টি কংক্রিটের সড়ক দু’দিকে চলে গেছে। পূর্বদিকে চরগিরিশি ঘাট এবং দক্ষিণে নাটুয়ারপাড়া ডিগ্রি কলেজ-পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে তেকানি ইউনিয়ন, পানাগাড়ি হাট, কান্তনগর, জুমার খুকশিয়া পারি দিয়ে সদর উপজেলার মেছড়া ইউনিয়নের রুপসা বাজার পর্যন্ত চলে গেছে। অপরদিকে, পানাগাড়ি হাট থেকে নতুন আরও একটি রাস্তা পূর্বদিকে নিশ্চিন্তপুর ইউনিয়নের দিকে চলে গেছে। এভাবেই কংক্রিটের সড়কের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে চরাঞ্চলের ইউনিয়নগুলোর আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা।
পানাগাড়ি হাট থেকে ঘোড়ার গাড়ি ছুটিয়ে আসছিলেন ২৪ বছর বয়সী আশরাফুল। তিনি কৃষকের পণ্য বোঝাই করে হাটে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধ তোফাজ্জল হোসেন, আমির আলীসহ চার কৃষক। তারা ঘোড়ার গাড়িতে সবজি নিয়ে পানাগাড়ি হাটে এসেছিলেন। সেগুলো বিক্রি করে ফিরে যাচ্ছেন তারা। নির্মাণাধীন অপর এক রাস্তায় ব্যাটারি চালিত অটোরিকশায় সিমেন্টের বস্তা নিয়ে যাচ্ছিলেন আওয়াল।
জানতে চাইলে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, বাবা-দাদার আমল থেইকে বালুর রাস্তায় পায়ে হাঁইট্যা পানাগাড়ি, নাটুয়ারপাড়া হাটে আইসত্যাম। মাথায় বোঝা নিয়্যা ৫/১০ মাইল গরম বালুর রাস্তায় দিয়্যা যাতায়াত যে কি কষ্টের-ভাবতেও গায়ে কাটা দেয়। নাটুয়ারপাড়া-রুপসা রাস্তা হওয়ার পর অ্যাহন ঘোড়ার গাড়িতে ক্ষেতের ফসল তুইল্যা নিজেরা অটোরিকশায় চইল্যা আসি। আগে হাটে আইসতে দেড় ঘণ্টা সময় লাইগতো-অ্যাহন লাগে ১৫ মিনিট। নাসিম সাহেব আমাগোরে এ রাস্তা কইর্যা দিচে। আল্লায় যেন তাক কবরে ভালো রাহে-মনের আবেগেই কথাগুলো বলে ফেলেন তোফাজ্জল। তার সঙ্গে সায় দিলেন অন্যান্য কৃষকেরা।
কথা হয় আক্তার হোসেন, রাব্বি, জুলমাত আলী, মাহমুদ হাসান, বাদশা আলম, জাহাঙ্গীর হোসেনসহ বিভিন্ন বয়সী কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে। চরের অতিত ও বর্তমান জীবনের পার্থক্য তুলে ধরে তারা বলেন, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি ও ধুনট, সিরাজগঞ্জের সদর ও কাজিপুর এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার যমুনার চরাঞ্চলগুলোর অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র নাটুয়ারপাড়া হাট ও বাজার। এ হাট-বাজারকে ঘিরেই চরের মানুষের অর্থনীতির চাকা ঘোরে।
স্বাধীনতার আগে থেকেই বর্ষা মৌসুমে নৌকা আর শুস্ক মৌসুমে হেঁটে এবং গরু-ঘোড়ার গাড়িতে মালপত্র তুলে নাটুয়ারপাড়া হাটে যাতায়াত করতে হতো অত্র অঞ্চলের সবাইকে। শুস্ক মৌসুমে সারিয়াকান্দি কিংবা সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছড়ার চর থেকে এ হাটে আসতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগতো। তাছাড়া চরের মানুষ এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের আত্মীয়ের বাড়ি যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগতো। চরবাসীর কষ্টের যেন কোনো অন্ত ছিল না।
১৯৯৭ সালে নাটুয়ারপাড়া থেকে চরগিরিশ পর্যন্ত প্রথম পাকা রাস্তা নির্মাণের পর এখানকার মানুষ স্বপ্ন দেখতে থাকে। এরপর ২০০৯ সালে নাটুয়ারপাড়া-রুপসার চর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি নির্মিত হওয়ার পর চরের চেহারাই পাল্টে যায়। এক সময় হেঁটে চলা মানুষগুলো এখন, অটোরিকশা, সিএনজি কিংবা ব্যাটারি চালিত ভটভটিতে চলাচল করেন।
তেকানি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন-অর-রশিদ বলেন, কাজিপুর এলাকার বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের হাতেগড়া উন্নয়নে ভাসছে এখন চরের মানুষ। অনেক রাস্তা হয়েছে। আরও নতুন নতুন রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে।
কাজিপুর উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী আব্দুস সালাম বলেন, যমুনার অভ্যন্তরের চরাঞ্চলে প্রায় ১৯টি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য ৫৭ কিলোমিটার। তিনটি রাস্তা হয়েছে ১৯৯৬-০১ সালের মধ্যে। বাকি ১৬টি রাস্তা ২০০৮-২০২০ সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছে। এ রাস্তাগুলো নির্মাণ হওয়ায় নাটুয়ারপাড়া-তেকানী-নিশ্চিন্তপুর-চরগিরিশি-মনসুরনগর, মেছড়া ও কাওয়াকোলা ইউনিয়ন ছাড়াও সরিষাবাড়ীর কিছু অংশের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছে।
কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদ হাসান সিদ্দিকী বলেন, গ্রাম হবে শহর- প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে বাস্তবায়ন করতে আমরা কাজ করছি। চরাঞ্চলের মানুষের মধ্যেও এখন শহরের সুবিধা পৌঁছে গেছে। নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। গত চার মাসে টি-আর কাবিখার বরাদ্দ থেকে ৪০ কিলোমিটার মাটির রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এসব রাস্তা এক সময় পাকা রাস্তায় পরিণত হবে।
সিরাজগঞ্জ-১ (কাজিপুর ও সদরের একাংশ) আসনের সংসদ সদস্য প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয় বলেন, কাজিপুর উপজেলার প্রায় অর্ধেক মানুষ চরাঞ্চলে বাস করেন। জনগণের বিরাট এ অংশটির কথা মাথায় রেখে আমার বাবা মোহাম্মদ নাসিম ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত তিনটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় চরের রাস্তা নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পরে। এরপর ২০০৮ সালে বাবা নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাবার অনুপ্রেরণায় আবার চরের রাস্তা নির্মাণে উদ্যোগী হই। ২০২০ সাল পর্যন্ত ১৬টি রাস্তা নির্মাণ দুর্গম চরের মানুষের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। আরও নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে আশা করি, এ সরকারের মেয়াদেই আরও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তা পাকা করতে পারব।
সূত্র: বাংলানিউজ
এম ইউ/ ০৭ জুন ২০২১