অবশেষে কানাডা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের একটা দিশা হলো। বেশ কিছুদিন ধরে সংগঠনটি নানানমুখি অপতৎপরতার মোকাবেলা করে শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে একটি কার্যকরি কমিটি গঠন করতে পেরেছে।
সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৮ সালে ইয়ং ষ্ট্রিটের রাজনগর রেষ্টুরেন্টে। উদ্দেশ্য ছিল কানাডিয়ান বাংলাদেশিদের ব্যবসা করার জন্য উৎসাহ প্রদান, কোথায়, কি ধরনের সুযোগ সুবিধা আছে এগুলো জানানো। কিন্তু পরবর্তীতে যা ঘটলো তা একেবারে অন্যরকম। চেম্বারের সহযোগিতা ছাড়াই উৎসাহী বাংলাদেশিরা একে একে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা শুরু করলেন এবং দেখতে দেখতে শতাধিক বাংলাদেশি মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠলো। মাঝখানে বাঙালি চরিত্রের নিয়ম মাফিক যা হবার তাই হলো। কতিপয় ব্যক্তি সংগঠন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ‘বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিল’ নাম দিয়ে আরেকটি সংগঠন করলেন। কিছুদিন যেতে না যেতে এক পর্যায়ে ঐ সংগঠনের কর্মকান্ড আবার বন্ধও হয়ে গেলো। এদিকে মূল সংগঠনে কিছু অসাধু এবং অব্যবসায়ী নানান সমস্যা সৃষ্টি করছিল। কিছু দাগি চোরাকারবারিও ঢুকে পড়ে সংগঠনের বারোটা বাজিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে এ সংগঠনের কর্মকান্ডও স্থবির হয়ে যায়।
নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে বাংলাদেশ থেকে পেশাজীবীদের সাথে সাথে ইনভেষ্টর ক্যাটাগরিতে অনেকে ইমিগ্রেশন নিয়ে আসতে শুরু করলেন। কেউ কেউ ব্যাংকের টাকা মেরে সোজা কানাডায়; কেউ কেউ নানান প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নিয়ে এদেশে পাড়ি জমালেন। এ তালিকায় রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ এবং শত শত ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ কমিউনিটিতে একটি শ্রেণী বিভাজন সৃষ্টি হয়ে গেলো। একটা হলো শ্রমজীবী বাংলাদেশী (যারা কানাডিয় সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করেন); আরেকটা হলো বাংলাদেশ থেকে আগত তথাকথিত ধনী বণিক (যারা এদেশে কোন ট্যাক্স প্রদান করেন না)। জন্ম নিলো ‘বেগম পাড়া’র। এ পাড়ায় কেবল বেগমরা বসবাস করেন; আর সাহেবেরা আসা যাওয়ার মধ্যে থাকেন। আয়-রোজগার সব বাংলাদেশে; খরচ এ দেশে। সাহেবেরা নানান কায়দায় দেশ থেকে টাকা পাচার করে নিয়ে আসেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঐ সময় টরন্টোতে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বেড়ে যায়। ইন্সুরেন্স কোম্পানী, ট্রেভেল এজেন্সি, রিয়েল এষ্টেট, গ্রোাসারি, মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে এক শ্রেণীর টাউট সাধারণ বাংলাদেশীদের কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নেয়। অনেক গ্রোসারির মালিক বাংলাদেশ থেকে কন্টেইনার ভরে মাছ আমদানী করে রফতানীকারককে লক্ষ লক্ষ ডলার ঠকিয়ে হজম করে ফেলে। অনেক প্রতারক অন্যান্য দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করে কানাডা পালিয়ে এসে ঐসব অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে আশ্রয় লাভ করে।
বছর দুই আগে নব-নির্বাচিত এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আরিফ রহমান বিলুপ্ত প্রায় চেম্বার অব কমার্সকে পুনরুদ্ধার করার মিশন নিয়ে মাঠে নামেন। অত:পর স্থানীয় ম্যান্ডারিন রেষ্টুরেন্টে মিডিয়ার সাথে চেম্বার অব কমার্সের এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে গিয়ে শুনলাম আপাতঃকালীন একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নাম কিং হোসেন। জনৈক সৈয়দ নাজমুল হোসেন মনা রিয়েল এষ্টেট ব্যবসায় নেমে এ নাম ধারণ করেন। আমি সভাকক্ষে উপস্থিত সকলের সামনে এ নাম নিয়ে আপত্তি তুলে বললাম আপনারা ব্যবসায়ীরা সংগঠন করবেন ভাল কথা কিন্তু এসব নাম ব্যবহার করে লোক হাসাবেন না। উদাহরণ হিসেবে আমি বললাম, এদেশে বাংলাদেশ থেকে শামসু এসে হয়ে গেছে ‘স্যাম’, জসিম হয়ে গেছে ‘জ্যামস’, জরিনা হয়ে গেছে ‘জেরি’, বাকি ছিল জর্দানের বাদশা হওয়ার… এসব ফাজলামি করা বন্ধ করেন। সংগঠনের প্রায় সকল কর্মকর্তারা আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞাপণগুলোতে আর ‘কিং হোসেন’ নাম ব্যবহার করা হয়নি।
পুনরুদ্ধারকৃত সংগঠন আবার জেগে উঠলো। অর্থাৎ সদস্য সংগ্রহ শুরু হলো। এক পর্যায়ে প্রায় ১২০জন সদস্য সংগঠনে তাদের নাম তালিকাভূক্ত করলেন। অত:পর চেম্বার এর পক্ষ থেকে গালা ডিনারের আয়োজন করা হলো। সে অনুষ্ঠানে সংগঠনের সদস্যরা ছাড়াও প্রাদেশিক সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ব্যাংকার এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা আসলেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সবই সুন্দর ভাবে চলছিলো কিন্তু ভারপ্রাপ্ত সভাপতির মাথায় মুকুটের ভার বুঝি সইলো না! অনুষ্ঠানের পূর্বক্ষণে অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে তিনি টালমাটাল হয়ে মঞ্চে উঠে অসংলগ্ন কথা বার্তা বলা শুরু করলেন। সংগঠনের সদস্যরা তার আচরণে হতবাক হয়ে যান। কোন ধরনের ফলাফল, কোন ধরনের সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা ছাড়াই ঐদিন অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘটে। পরদিন থেকে সদস্যদের ফোনগুলো গরম হয়ে যায়। একের পরে এক রিং বাজতে থাকে আর সংগঠনের সদস্যরা ফোনের মাধ্যমে তাদের দুঃখ আর যন্ত্রণার ক্ষোভ ঝাড়তে থাকেন। কথা উঠে সংগঠনের পরবর্তী সভায়। সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নাজমুল হোসেন মনাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের দাবী তুলেন। এ সময় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কতিপয় সদস্যকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে ফেলেন। তার অভিযোগ ছিল আরিফ এবং মাঈনুল সংগঠনের তহবিল তসরুফ করে ফেলেছে। এদের হাতে সংগঠন নিরাপদ নয়। তার কথায় বিশ্বাস করে নাসির কাসেম (বর্তমান সহ সভাপতি) এবং হেলাল উদ্দিন খান (বর্তমান সাধারণ সম্পাদক) তার সাথে যোগ দেন।
গত ১৩ মে ২০১৮ বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সদের এক জরুরী সভা আহবান করা হয়। সভায় সৈয়দ নাজমুল হোসেন মনার বিরুদ্ধে ৯টি অভিযেোাগ এনে কানাডা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্সের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদসহ সংগঠনের সকল পদ থেকে তাকে বহিষ্কার এবং মাঈনুল খানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সভাশেষে এক প্রেস কনফারেন্সে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে সকল বাংলা মিডিয়াকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পাঠান তারা। ঐ সভায় ৮ জুলাই বার্ষিক সাধারণ সভার তারিখ ঘোাষণা করা হয়।
এদিকে সৈয়দ নাজমুল হোসেন মনার পক্ষাবলম্বনকারী নাসির কাসেম এবং হেলাল খান এক জরুরি সভা আহবান করেন গ্র্যান্ড প্যালেসে। সভায় বিক্ষুব্ধ সদস্যরা উপস্থিত হয়ে তাদের নানান প্রশ্ন করেন। তখন নাসির কাশেম অর্থ আত্মসাৎসহ আরিফ এবং মাঈনুলের বিরুদ্ধে সংগঠন ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন অভিযোগ আনেন। সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়তে থাকে।
পরবর্তীতে ধারবাহিক নাটকের মতো একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। এক পর্যায়ে দুই গ্রুপ এক হয়ে যায় কেবল সৈয়দ নাজমুল হোসেন ছাড়া। সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা একীভূত হওয়ার খবর শুনে খুশি হলেও বিস্মিত হয়ে যান। দুই দিন আগে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল অর্থ আত্মসাতের আজ তাদের সাথে গলায় গলায় ভাব সেইসব অভিযোগকারীদের! সকলেই জানতে চান রহস্য কি? কিসের ভিত্তিতে এ সমোঝোতা?
অবশেষে নাটকের শেষ অংশ অনুষ্ঠিত হলো গত ৩০ সেপ্টেম্বর। এর আগে উল্লিখিত তারিখে সাধারণ সভা ও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। ব্যবসায়ীরা ছুটে গেলেন পাঁচ তারকা হোটেল শেরাটনে। ইলেকশন নয় সিলেকশন পদ্ধতিতে পদগুলো ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়া হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঢেকুর তুলতে তুলতে সভ্যগণ ফিরে এলেন যার যার ঘরে। পরদিন থেকে আবারও ফোন বাজতে থাকে। ‘তারা তারাই তো’…।
একটি মজার গল্প মনে পড়ছে। গ্রামের ছোট এক বালক খেলার মাঠে খেলছিলো। এ সময় পাশের রাস্তা দিয়ে একটি বর-কনের বহর যাচ্ছিলো। পালকিতে কনে বসে রয়েছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলা ছেড়ে কনে দেখতে গেলো। ঐ বালকটি এর আগে কোনদিন কনে দেখেনি। তার বন্ধুদের কাছে বিষয়টি জেনে নিয়ে সে এক দৌঁড়ে বাড়িতে গিয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘মা, মা, তোমার বিয়ে হয়েছে কার সাথে?’ মা বললেন, ‘কেন? তোর বাপের সাথে’। বালকটি বললো- দূ-উ-উ-র.. এতো দেখছি ‘তোমরা নিজেরা নিজেরা’!