সম্পাদকের পাতা

বাংলাদেশ কমিউনিটিকে হাস্যকর করে তুলবেন না

নজরুল মিন্টো

টরন্টো নগরীর মেয়র পদে এবার প্রার্থী হয়েছেন তোফাজ্জল হক নামে এক বাংলাদেশি-কানাডিয়ান। কানাডা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। যে কোন নাগরিক নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। এটা তার নাগরিক অধিকার। তবে তোফাজ্জল হকের প্রার্থীতা নিয়ে কমিউনিটিতে আলাপ-আলোচনার চাইতে হাসাহাসির রেশটা একটু বেশি বলে মনে হচ্ছে। কেউ বলেন- তার কি যোগ্যতা আছে?, কেউ বলেন কে চেনে তাকে? কেউ বলেন কমিউনিটিতে তার অবদান কি? কোন সংগঠনের সাথে তিনি জড়িত? এসোসিয়েশন? সোসাইটি? সাংস্কৃতিক? সামাজিক? ধর্মীয়, আঞ্চলিক? না, কমিউনিটির কোন সংগঠনের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা নেই। কানাডার মূলধারার কোন সংগঠনের সাথেও তিনি জড়িত নন। কোন ধরনের চ্যারিটি বা সেবামূলক কাজেও তার সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যায় না। তবে বেশিরভাগ লোকই বলছেন সস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য তিনি প্রার্থী হয়েছেন (পেয়ে গেছেনও বটে! শুনলাম, এ খবর শুনে নাকি তার দেশের বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।)। অনেকেই বলছেন, কানাডার প্রধান এ নগরী সম্পর্কে তার নুন্যতম ধারণা নেই। তাদের ভাষ্য, একজন মেয়রের দায়িত্ব কতটুকু তা যদি তিনি জানতে পারতেন তাহলে হয়তো ৭০ বার ভাবতেন।

ভাববার বিষয় বটে! প্রায় ৭ হাজার স্কোয়ার কিলোমিটারের এ নগরীর লোক সংখ্যা ৬৫ লক্ষেরও বেশি। বৃহত্তর টরন্টো থেকে ২৩ জন এমপি এবং ২২ জন এমপিপি কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। মেয়রের নির্বাচনী এলাকা সকল এমপি এবং এমপিপির এলাকার সমষ্টি। টরন্টো নগরীর মেয়র কেবল ৪৪ জন কাউন্সিলেরের প্রতিনিধিত্ব করেন না; তিনি পদাধিকার বলে পুলিশেরও প্রধান। অন্যান্য পদগুলোর কথা আর নাইবা বললাম। যতটুকু জানি, তোফাজ্জল হক এ পর্যন্ত মাত্র দু’টি সভা করেছেন। দুটোই বাংলাদেশ কমিউনিটির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কেবল বাংলাদেশ কমিউনিটি বললে ভুল হবে; দুটো সভাই ছিল ড্যানফোর্থের বাংলা পাড়ায়। প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় মীজান কমপ্লেক্সে যখন তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে আসেন। আর সপ্তাহ দুই আগে তিনি দ্বিতীয় সভাটি করেন ডজ রোডের লিজিওন হলে। যেখানে তিনি এক অভিনব নির্বাচনী ফর্মূলা বয়ান করেন। (তার ফর্মূলা অনুযায়ী বাংলাদেশ কমিনিউটির ৪৫ হাজার ভোটার প্রত্যেকেে তাকে ভোট দিবে এবং এই প্রত্যকেের দায়িত্ব হলো ১০টি করে ভোট সংগ্রহ করার। এবার ৪৫ হাজারকে ১০ দিয়ে গুণ করে দেখুন কত হয়! অর্থাৎ ৪ লাখ ৫০ হাজার। ব্যাস হয়ে গেলো। সভাশেষে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন- বাংলার এ কৃতি সন্তান এতোদিন কোথায় ছিলেন?)

অন্যান্য মেয়র প্রার্থীরা যখন একের পর এক ডিবেটে অংশ নিচ্ছেন তখন তোফাজ্জল হক বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকার মসজিদে মসজিদে ফ্লায়ার বিতরণ করে চলেছেন। অন্যান্য মেয়র প্রার্থীরা যখন ৬টি এলাকায় (ডাউন টাউন, আপটাউন, ইষ্ট ইয়র্ক, নর্থ ইয়র্ক, ইটোবিকো, স্কারবোরো) ক্যাম্পেইন অফিস স্থাপন করে একেকটি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন তখন তোফাজ্জল হক বায়তুল আমান মসজিদ থেকে সুইস বেকারি এই ৫০০ মিটার পথ হেঁটে; জীবনানন্দ দাশের ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…’ মনে করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। অনেকেই প্রশ্ন করেন- তিনি কি ড্যানফোর্থের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার মেয়র পদপ্রার্থী না কি টরন্টো নগরীর? অনেকে এ নিয়ে আবার কোনো আলাপই করতে চান না। এদিকে মূলধারার কোন মিডিয়া দূরে থাক, হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি, তামিল, ফারসি এমনকি বাংলাদেশি মিডিয়াগুলোতেও তাকে নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ফেসবুকসহ কোন সোশ্যাল মিডিয়াতে কেউ দু”লাইন লিখে তাকে উৎসাহ দিতেও দেখা যায় না।

কেন এ নীরবতা? কেন কেউ উৎসাহ পাচ্ছেন না? গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে ১০০ ডলার দিয়ে নোমিনেশেন কিনে জাতির দোহাই দিয়ে যত নাটকই মঞ্চস্থ করুন না কেন বাঙালি এগিয়ে আসবে না। এরও আগে জনৈক আব্দুল্লাহ হেল বাকি নামে আরেক বাংলাদেশি-কানাডিয়ান মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তামাশা করার জন্য এমপি পদে প্রার্থী করা হয়েছিলো জনৈক ফটিক চৌধুরিকে। এবার তোফাজ্জল প্রার্থী হওয়ার খবর শুনে ডালিম নামে ড্যানফোর্থের এক ভবঘুরেকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিল একটি মহল। হাতে পায়ে ধরে এ তামাশা বন্ধ করতে পেরেছিলাম। তাদেরকে বলেছিলাম তোমাদের জন্য এটা মজা হতে পারে কিন্তু অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠির কাছে আমাদের গোটা কমিউনিটি হাস্যকর হয়ে যাবে।

বাঙালির চক্ষু লজ্জা এখনও আছে। বাঙালি গণতন্ত্র বুঝে, যোগ্য-অযোগ্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা বাঙালির আছে। আছে বলেই ডলি বেগমকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে অন্টারিওর পার্লামেন্টে নিয়ে আসতে পেরেছে।

সবশেষে একটি সত্য ঘটনা দিয়ে এ লেখাটি শেষ করতে চাই। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে আমার ইউনিয়নে একবার এক চেয়ারম্যান প্রার্থী মাত্র ১ ভোট পেয়ে বাড়িতে এসে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। পাড়া প্রতিবেশিরা এগিয়ে এসে ঘটনা কি ঘটেছে জানতে চাইলে সে জানালো, তার বউ তাকে ভোট দেয়নি। যদি সে (বউ) ভোট দিত তাহলে তার বাক্সে ২টি ভোট পড়তো। যথারীতি তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়।

কানাডাতে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার সিষ্টেম নেই। অতএব চিন্তার কারণ নেই। তবে অনুরোধ থাকবে ভবিষ্যতে কেউ আর ‘তোফাজ্জল’ হতে যাবেন না। বহুজাতির দেশ কানাডায় বাংলাদেশি সমাজকে হাস্যকর করে তুলবেন না। আমাদের ছেলেমেয়েদের যোগ্য করে গড়ে তুলুন; তাদেরকে সুযোগ দিন।

Back to top button