গত ১ ও ২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ৪র্থ বিশ্ব সিলেট সম্মেলন। একটি সফল অনুষ্ঠানের মানদন্ডে যা যা থাকা দরকার সবই ছিল সে অনুষ্ঠানে। হাজার হাজার লোক উপভোগ করেছেন দুইদিনব্যাপী এ সম্মেলনের অনুষ্ঠানমালা। জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব নিউইয়র্কের সভাপতি বদরুল খানের ভাষায় ‘এটা মহাসম্মেলনে রূপান্তরিত হয়েছে’।
একটি সফল অনুষ্ঠানের পেছনে একটা সুন্দর টিম থাকে। এ আয়োজনের পেছনেও ছিল একটি সুশৃঙ্খল টিম। এ সফল আয়োজনের সাথে আমি কিঞ্চিত জড়িত ছিলাম সে আলোকে আমি লক্ষ্য করেছি এ টিমের কর্মকান্ড।
এ টিমের প্রত্যেকটি সদস্যের যেমন সদিচ্ছা ছিল; তেমনি চিন্তা-চেতনায়ও তারা ছিল এক। কোন বিষয় কেউ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। কেউ কাউকে টপকে যেতেও চায়নি। এ সম্মেলনে সৃজনশীলতার যে নমুনা তারা দেখিয়েছে তা উত্তর আমেরিকা প্রবাসীরা দীর্ঘ দিন মনে রাখবে বলে বিশ্বাস। গ্র্যান্ড প্যালেসের পার্কিং লটকে তারা টাইম স্কোয়ারে রূপান্তরিত করে দেখিয়ে দিয়েছে সৃজনশীলতা কি এবং কাকে বলে! অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়ে বিশাল তোরণ, ফটো গ্যালারি, সিলেটের ল্যন্ডম্যার্ক আলী আমজদের ঘড়ির রেপ্লিকা স্থাপনসহ প্রত্যেকটি কর্মকান্ডে ছিল নান্দনিক ছোঁয়া। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অতিথিদের সম্মানার্থে তাদের দেশের (বাংলাদেশ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত ও জার্মানী) পতাকা উত্তোলন করে সম্মেলনকে যে আন্তর্জাতিক রূপ দেয়া হয়েছে সেটাও ছিল দর্শকদের জন্য বিরাট চমক! বাঙালিদের দ্বারা এমন আয়োজন এ উত্তর আমেরিকায় কেউ কি দেখেছে কখনও?
অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকে প্রত্যেকটি দর্শক চমকে গেছেন! এত বড় মঞ্চ! নয়নাভিরাম এ মঞ্চের বিশালতা ও উচ্চতা সিলেটিদের মনের বিশালতা ও চিন্তার উচ্চতার প্রতীক হিসেবে যুগযুগ ধরে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
তিনটি মঞ্চে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তা মঞ্চস্থ করা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তাও সফল হয়েছে কেবল টিম লিডারের কারণে। বলছি কনভেনর রাশেদা কে চৌধুরির কথা। তার প্রত্যেকটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে তার টিম। আর যিনি পরামর্শক এবং সম্মেলনের মূল কারিগর তিনি হচ্ছেন ডা. জিয়া উদ্দিন আহমেদ। টরন্টো থেকে ফিলাডেলফিয়া কত দূর তিনি বুঝতে দেননি। প্রতিটি মুহর্তে তিনি ছিলেন এ টিমের সাথে। আর জালালাবাদ এসোসিয়েশন ঢাকার সভাপতি সিএম তোফায়েল সামির উৎসাহ এবং প্রেরণা ছিল এ টিমের জন্য বাড়তি পাওয়া। সবকিছু মিলিয়ে সম্মেলন সার্থক হলো তখন যখন দেখা গেলো হাজার হাজার দর্শক উপভোগ করেছেন সম্মেলনের অনুষ্ঠানমালা।
দুইদিনব্যাপী এ সম্মেলনে অতিথিদের জন্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনটি ছিল চোখে পড়ার মতো। শত শত অতিথিদের জন্য সকালে, দুপুরে, বিকেলে এবং রাতে খাবারের আয়োজন চাট্টিখানি কথা নয়। সিলেটিদের আতিথেয়তার একটি নমুনা দেখে অনেকেই অবাক হয়ে গেছেন। এও কি সম্ভব! হ্যাঁ সম্ভব হয়েছে কেবল সদিচ্ছার কারণে। এ সময়গুলোতে সংগঠনের সদস্যদের যে সার্ভিস দেখলাম তাতে আমি অবাক! তাদের টিমওয়ার্ক দেখে বিস্মিত হয়েছেন অতিথিরাও।
টিমওয়ার্কের আরেকটি নমুনা পেশ না করে পারছি না। এ ধরনের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। শুরুতে সংগঠনের সদস্যরা প্রত্যেকে নিজ পকেট থেকে সম্মেলনের তহবিল তৈরি করে ফেললো। এরপর শুভাকাঙ্খী, শুভানুধ্যায়ী এবং স্পন্সরদের কাছ থেকে অর্থ আসা শুরু হলো। লক্ষাধিক ডলারের এত বড় আয়োজন সুসম্পন্ন হয়ে গেলো গেলো কেবল সুশৃঙ্খল একট টিমওয়ার্কের কারণে।
আমার সাথে স্বাগতিক সংগঠন জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সম্পর্ক বেশিদিনের নয়; যদিও প্রতিষ্ঠাকালীন সময় (১৯৯০ সাল) আমি জড়িত ছিলাম। বর্তমান কমিটির সদস্যরা অপেক্ষাকৃত তরুণ। আমাকে যখন সিলেট বিশ্ব সম্মেলনের ক্যানাডা চ্যাপ্টারের কোঅর্ডিনেটর করা হলো এবং তারা যখন আমার পরামর্শ এবং সহযোগিতা চাইলো আমি সন্দিহান ছিলাম- এদের সাথে আমি কাজ করতে পারবো কিনা! আমার পরামর্শ তারা পালন করবে কি না! আমার সম্মান তারা রাখবে কি না! কিন্তু যখন কাজ শুরু করলাম তখন লক্ষ্য করলাম আমাকে তারা যে আসন দিয়েছে তা আমি চিন্তাও করিনি। যতই তাদের ঘনিষ্ট হয়েছি ততই অভিভূত হয়েছি। যা যা করতে চেয়েছি সবই তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তাদের মধ্যে সাম্প্রাদায়িক বিষবাষ্প ছিল না, রাজনীতি ছিল না, ছিল বুকভরা দেশপ্রেম। স্বপ্ন ছিল একটি সফল আয়োজনের। তাদের সে স্বপ্ন পুরণ হয়েছে। আমিও তাদের এ সাফল্যের একজন ক্ষুদ্র অংশীদার হয়ে গেলাম।
আমি গত কয়েক বছর ধরে আমাদের তরুণদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলে আসছিলাম। তাদের কাছে দায়িত্ব দিলে তারা যে সুন্দর কিছু উপহার দিতে পারবে চতুর্থ বিশ্ব সম্মেলন ছিল তার প্রমাণ। জালালাবাদ এসেোসিয়েশনের সভাপতি দেবব্রত দে তমাল, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরি রণি, সহ সভাপতি ফয়জুল চৌধুরি, ইন্তেখাব তুহিন, ইলিয়াস, আহমেদ জয়, এজাজ, মেহেদি রাসেল, সুদিপ সোম রিংকু, জুমেল, মেহেদি মারুফ, লায়েক আহমেদ চৌধুরি, মজিরুল হক মুজিব, আব্দুল জব্বার, শাহজাহান উদ্দিন, অজয় দাস, মিজানুর রহমান চৌধুরি, সৈয়দ আফসার, মকবুল হোসেন মঞ্জু, রাফে, রাহি, সুমন, লনি, জাভেদ, হাবিবুর রহমান মারুফ, রিপন বখত, শরিফ আহমেদ, আব্দুল হামিদ সহ নাম না জানা যেসব তরুণেরা দিনরাত পরিশ্রম করে এ আয়োজনকে সফল করেছে তাদের আমি জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন।
এ লেখায় আমি ধন্যবাদ দিতে চাই গ্র্যান্ড প্যালেস-এর সত্বাধিকারী শামীম চৌধুরিকে। যিনি বিনা বাক্যে সম্মেলনের জন্য তার পুরো ব্যাঙ্কুয়েট হল এবং হাজার হাজার গাড়ি পার্কিং এর জন্য আশে পাশের সকল কোম্পানীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখেছেন। শুধু তাই নয়; সম্মেলনকে সফল করতে সব ধরনের সাপোর্ট নিয়ে তিনি এগিয়ে এসেছেন। ধন্যবাদ দিতে চাই প্রাইম প্রিন্টার্স-এর সত্বাধিকারি আব্দুল ফাত্তাহকে। যিনি মাত্র দুইদিনে প্রায় ১৫০ পৃষ্ঠার একটি স্যুভেনির প্রিন্ট করে দেয়ার জন্য বিরাট রিস্ক নিয়েছিলেন। বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই উজ্জ্বল দাশকে যিনি স্যুভেনিরের প্রচ্ছদসহ ছবি এক্সিবিশনের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব একাই ঘাড়ের উপর নিয়ে সম্মেলনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। অনেক কাজ অর্থ দিয়েও করানো যায় না; কিন্তু উল্লেখিত তিনজন অর্থ ছাড়াই তাদের শ্রম, মেধা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া অনেক ব্যবসায়ী হাসিমুখে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন যাদেরকে বলতে হয়নি। তাদেরকেও আমি ধন্যবাদ জানাই।
ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশ থেকে আগত জনপ্রিয় শিল্পী কালা মিয়া, আশেক, যুক্তরাজ্য থেকে আগত হিমাংশু গোষ্বামী, নিউইয়র্ক থেকে আগত শিল্পী তাজুল ইমামকে। ধন্যবাদ জানাচ্ছি এ জন্যে যে, সাধারণত: কোন অনুষ্ঠানে তারা গান গাইতে গেলে তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে আনতে হয় অথচ বিশ্ব সিলেট সম্মেলনে পারিশ্রমিক চাওয়া দূরের কথা; উল্টো তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন আর কোনভাবে তারা সাহায্য করতে পারেন কি না!
যা পারিনি: কথা ছিল সম্মেলনে সবাইকে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ‘চুঙ্গা পিঠা’ (টিউব কেক) খাওয়াবো। কিন্তু আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। এজন্য দুঃখিত।
সবশেষে একটি সংশোধনী না দিলে সারাজীবন আমি নিজেকে অপরাধী ভাববো।
সম্মেলনের দ্বীতিয় দিনে সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আগত ঢাকা জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সহ সভাপতি, ফেঞ্চুগঞ্জের কৃতী সন্তান, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরি তাঁর ভাষণে আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন আমার বাবার কথা যিনি (রশীদ আমিন হিসেবে পরিচিত) ১৯৭১ সালে ফেঞ্চুগঞ্জ তথা সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক ছিলেন; আমি মু্ক্তিযোদ্ধা নই; আমি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পিতার গর্বিত সন্তান!
পুনশ্চ: আজ সকালে আমার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে বীথিকা আমাকে বললো, ‘আব্বুু, আমার জীবনে আমি বাঙালিদের এত বড়, আর এত সুন্দর অনুষ্ঠান দেখি নাই’ আনন্দ আর খুশিতে আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। আমরা সফল, আমরা সার্থক। জয় হোক আমাদের নতুন প্রজন্মের। জয় হোক তারুণ্যের!!!