সম্পাদকের পাতা

দুই চাকার বিপ্লব

নজরুল মিন্টো

আর দশজনের মতো ছোটবেলায় আমারও বাইসাইকেল চালানোর সখ ছিল। সাইকেল চালাতে গিয়ে হাঁটুতে কত হোঁচট খেয়েছি তার হিসেব নেই। এখনও সেই হোঁচটের দাগ সাক্ষ্য দিয়ে স্মৃতিকে জাগরুক রেখেছে । তারপর অনেকদিন কেটে গেছে আর সাইকেলে ওঠা হয়ে উঠেনি। এমনকি আর কোনদিন সাইকেল চালাবো বলে চিন্তাও করিনি। কিন্তু হঠাৎ করে পরিবেশ, পরিস্থিতি আমাকে বদলে দিল। বিশ্বে দুই চাকার যে বিপ্লব চলছে সে বিপ্লবের আমিও একজন গর্বিত সৈনিক হয়ে গেলাম।

আর দশজনের মতো ছোটবেলায় আমারও বাইসাইকেল চালানোর সখ ছিল। সাইকেল চালাতে গিয়ে হাঁটুতে কত হোঁচট খেয়েছি তার হিসেব নেই। এখনও সেই হোঁচটের দাগ সাক্ষ্য দিয়ে স্মৃতিকে জাগরুক রেখেছে । তারপর অনেকদিন কেটে গেছে আর সাইকেলে ওঠা হয়ে উঠেনি। এমনকি আর কোনদিন সাইকেল চালাবো বলে চিন্তাও করিনি। কিন্তু হঠাৎ করে পরিবেশ, পরিস্থিতি আমাকে বদলে দিল। বিশ্বে দুই চাকার যে বিপ্লব চলছে সে বিপ্লবের আমিও একজন গর্বিত সৈনিক হয়ে গেলাম।

আমার পরিচিত অনেকে এখন বাইক চালায়। বিশেষ করে যারা জিমনেসিয়ামে আসে তারা গাড়ি রেখে বাইক চালাতে পছন্দ করে। এছাড়া যে পাড়ায় থাকি এরা প্রায় সবাই পরিবেশবাদী। প্রত্যেক ঘরে ৪/৫টি করে বাই সাইকেল। বিএমডব্লিউর চাইতে বাইসাইকেল এদের কাছে সম্মানের। গত বছর সামার শুরু হ্ওয়ার প্রারম্ভেই কানাডিয়ান টায়ার থেকে একখানা বাইক কিনে আনলাম। বাইসাইকেল কত প্রকার ও কি কি জানলাম এটা কেনার পর। সিঙ্গেল গিয়ার, মাল্টি গিয়ার, রেসিং বাইক, মেসেঞ্জার বাইক, ট্যুরিং বাইক, স্পোর্টস বাইক, ফোল্ডিং বাইক আরও কত কি! আমার কেনা রোড বাইকটি নাকি কেবল সমতল রাস্তায় চালানোর জন্য। যেহেতু আমি হিল এলাকায় থাকি এজন্যে আমাকে কিনতে হবে মাউন্টেইন বাইক। অবশেষে মাউন্টেইন বাইকই কিনলাম। বাইক চালিয়ে আমি এখন জিম, লাইব্রেরি, শপিং সেন্টার, এমনকি সাব্ওয়ে ষ্টেশন পর্যন্ত যাই। উইকএ-ে পাড়ায় পাড়ায় গ্যারেজ সেলগুলোতে ঘুরে বেড়াতে খুব মজা লাগে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ব্র্যা- নিউ ডজ ডোরাঙ্গো কিনেও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারিনি যতটা না আমার বাইক দিয়ে করতে পেরেছি। ডোরাঙ্গো দেখে কেউ কখনও এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেনি এটা কত দিয়ে কিনেছি! কি কি ফিচার আছে! কিন্তু আমার বাইক নিয়ে যেখানেই যাই লোকজন বিশেষ করে তরুণ/তরুণীরা এগিয়ে এসে নানা প্রশ্ন করে, প্রশংসা করে।

অনেকে মনে করতে পারেন নগরীর রাস্তায় আর কয়টা বাইক চলে? যাদের মনে এ প্রশ্ন তাদের জন্য কিছু তথ্য তুলে ধরছি। ১৯৯৩ সালের এক জরিপ অনুযায়ী টরন্টো নগরীতে বাই সাইকেল চালকের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ। এর আগে ১৯৮৬ সালের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। নগরীতে বাইক ব্যবহার করে কাজ করেন এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। পরিবেশবাদীরা বাইক চালকদের উৎসাহ দেয়ায় এ সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। জানা যায় এদের কারণে নগরীতে বছরে ৮০ হাজার টন বায়ু দূষণ কম হয়। এছাড়া ১৫৬ মিলিয়ন লিটার জ্বালানী অর্থাৎ ৭৮ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়ে থাকে। তাই পরিবেশ দূষণ থেকে শহরকে রক্ষা করার তাগিদে অনেক সচেতন নাগরিক গাড়ি থাকা সত্ত্বেও গ্রীষ্মকালে বাইক চালান। এছাড়াও ছাত্র/ছাত্রী এবং কুরিয়াররা নিয়মিত বাইক ব্যবহার করে থাকেন। পুরো গ্রীষ্মকালে টরন্টো পুলিশ বাইক ব্যবহার করে থাকে।

বাইসাইকেল ইন্ডাষ্ট্রি সূত্রে জানা যায়, অন্টারিওতে প্রতি বছর ৫ লক্ষ নতুন বাইসাইকেল বিক্রি হয়। যার মূল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার। টরন্টো নগরীতে গড়ে ৬০% নাগরিকের একটি করে বাইক আছে। বাইক চালকদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বর্তমানে টিটিসির বাসে বাইক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি অফ আওয়ারে সাবওয়েতে করেও বাইক নিয়ে যাওয়া যায়। এদিকে নগর কর্তৃপক্ষ ১০ বছর মেয়াদি একটি বাইক প্ল্যান হাতে নিয়েছে। নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ বাইক প্ল্যান কার্যকর ভূমিকা রাখবে এবং চার চাকার যানবাহনের উপর থেকেও নির্ভরশীলতাও কমে যাবে বলে জানা গেছে।

গত দুই বছরে ইউরোপ আমেরিকায় দুই চাকার এক বিপ্লব ঘটে গেছে। ইতিমধ্যে বাইকের গুণাগুন নিয়ে পরিবেশবাদীদের সাথে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা যোগ দিয়েছেন। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে বাইকের কার্যকারিতা নিয়ে নানা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। পাঠকদের সুবিধার্থে আমি বাছাইকৃত কিছু সার সংক্ষেপ তুলে ধরছি।

বাইক চালাতে কোন জ্বালানী লাগে না অতএব এটা পরিবেশ দূষিত করে না।

চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা বলেছেন সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যের জন্য মঙ্গলজনক। হাঁটা এবং সাইকেল চালানোর বিকল্প নেই। হাঁটলে এবং সাইকেল চালালে হৃদরোগের ঝুঁকি সহ অনেক অসুখ কমে যায়।

এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে দুই তৃতীয়াংশ কানাডিয়ান শারিরীকভাবে অচল এবং এর ফলে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ২.১ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হয়। শুধুমাত্র সদিচ্ছা থাকলে স্বাস্থ্য খাতের এই অতিরিক্ত অর্থ সাশ্রয় করা যায়।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, আপনি কোন বয়সী সেটা বড় কথা নয়। সাইকেল চালালে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে এটাই প্রমাণিত। যৌবনকে ধরে রাখতে হলে হাঁটতে হবে এবং সাইকেল চালাতে হবে।

বাইসাইকেলের পক্ষে যাই বলা হোক না কেন এর কারনে গ্রীষ্মকালটি গাড়ি চালকদের জন্য বড় কষ্টের; বিশেষ করে টরন্টো ডাউন টাউনে। এ সময় বাইক চালকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। লেন পরিবর্তন এবং গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে ছোটখাটো দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। আমারও হয়েছে। আমার এখনকার মানসিকতার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিলাম সে সময়। আমি বাইক চালকদের মোটেই দেখতে পারতাম না। কিছু সাইকেল চালক আছে যারা বড্ড বেপরোয়া। দেখা গেলো ঝড়ের গতিতে কোত্থেকে এসে গাড়ির দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো নইলে কোন রকম গা বাঁচিয়ে ফুটপাতে চিৎপটাং। শুরু হয় গালাগালি, কেউ কেউ মারমুখি হয়ে এগিয়েও আসে। প্রতি বছর আমার সাথে একটা/দুইটা ঘটনা লেগেই থাকে। একবার তো একজনকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। সারাটা রাস্তা যা পর্যন্ত পারে গালাগালি করতে করতে গেলো। হাসপাতালের বেড-এ শুইয়ে দিয়ে বারো ডলারের একটি ফুলের তোড়া কিনে দিতেই খুব খুশী। বার বার বলতে লাগলো ‘ইট ওয়াজ মাই ফল্ট, ইট ওয়াজ মাই ফল্ট’। সে মাতাল ছিল বলে সেদিন রক্ষা!

এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯৩ সালে প্রায় ১০ হাজার বাইসাইকেল চালক দূঘর্টনায় পতিত হয়। খবরে প্রকাশ ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বাইসাইকেল দূর্ঘটনায় মারা গেছে ১৬৬৫ জন। এদের মধ্যে ৫৭% কুড়ি বছর বয়সের নীচে।

বাইসাইকেলের বহু দোকান রয়েছে নগরীতে। একটি নতুন বাইসাইকেলের মূল্য মান অনুযায়ী ১০০ ডলার থেকে ৯,০০০ ডলার। পুরনো সাইকেলের দোকানও আছে। অনেকে চুরির ভয়ে পুরনো সাইকেল কিনে থাকে। কুইন ষ্ট্রীটের কাছে ষ্ট্রাচান এভিনিউতে রয়েছে ইগোর নামে এমনি একটি দোকান। এখানে একশ ডলারের কম মূল্যে সাইকেল কেনা যায়। এছাড়া ই-বে থেকেও পুরনো সাইকেল কেনা যায়। অনুরোধ করলে বিক্রেতারা আপনার ঘরে হোম ডেলিভারি দিয়ে যাবে। ট্রাফিক অ্যাক্ট অনুযায়ী সাইকেল এক ধরনের যানবাহন। কিন্তু গাড়ির চালকরা প্রতিনিয়ত সাইকেল চালকদের হয়রানি করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অযথা হর্ণ দেয়া, গাড়ির বাম্পার লাগিয়ে সাইকেলকে হিট করা অভিযোগগুলোর অন্যতম। এছাড়া নগরীতে বাইসাইকেলের জন্য পর্যাপ্ত রাস্তা নেই। যেটুকু আছে সেগুলো হঠাৎ করে শুরু হয়েছে এবং যেখানে যেখানে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে।

টরন্টো নগরীতে সবচেয়ে চুরি হওয়া আইটেমের মধ্যে বাইসাইকেল অন্যতম। বাইক চুরি যাওয়া একটি নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে এ ব্যাপারে চালকদের সবসময় সাবধানতা অবলম্বন করতে দেখা যায়। তারা তাদের বাইসাইকেল পার্ক করে রাখার সময় তালা দিয়ে যায়। কেউ কেউ আরও বেশি সর্তকতা হিসেবে হ্যান্ডেল সাথে নিয়ে ঘুরে অথবা চাকা খুলে রাখে। তারপর রক্ষা নেই। ১৯৯২ সালের হিসেব অনুযায়ী টরন্টোয় ১১ হাজার ৭৪৫ টি বাইসাইকের চুরি হয়েছে। নিউইয়র্ক নগরী থেকে এ সংখ্যা আড়াই হাজার বেশি এবং মন্িট্রয়লের চেয়ে দ্বিগুন। এও জানা গেছে যে, পুলিশ এ ব্যাপারে তেমন একটা সাহায্য করতে পারে না।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো বাই সাইকেল চালকদেরও সংগঠন আছে। নগরীতে এ ধরনের প্রায় ১৫০টি সমিতি রয়েছে।

Back to top button