সম্পাদকের পাতা

উল্টো রাজার দেশ

নজরুল মিন্টো

কানাডার অনেক কিছুই আমাদের কাছে আজব মনে হয়। সবকিছুই কেমন জানি খাপছাড়া। এ দেশে নতুন একজন আগন্তুকের কাছে ভালো লাগার পাশাপাশি অনেক কিছু বিস্ময়ও জাগায়। পানির কল ঘুরোতে হয় উল্টো, তালা খুলতে গেলে উল্টো, গাড়ি চালাতে হয় উল্টো (ডানদিকে)। এ যেন উল্টো রাজার দেশ।

কানাডার অনেক কিছুই আমাদের কাছে আজব মনে হয়। সবকিছুই কেমন জানি খাপছাড়া। এ দেশে নতুন একজন আগন্তুকের কাছে ভালো লাগার পাশাপাশি অনেক কিছু বিস্ময়ও জাগায়। পানির কল ঘুরোতে হয় উল্টো, তালা খুলতে গেলে উল্টো, গাড়ি চালাতে হয় উল্টো (ডানদিকে)। এ যেন উল্টো রাজার দেশ।

দোকানের নাম হলো ‘কানাডিয়ান টায়ার’। নাম দেখে মনে হবে এখানে বুঝি টায়ার বিক্রি হয়। অথচ না, শুধু গাড়ির টায়ার নয়, চকলেট, বিস্কুটও পাওয়া যায়। টিভি-ভিসিআর থেকে খেলাধূলার সরঞ্জাম কী নেই? কিন্তু সাইনবোর্ডে একটাই শুধু লেখা ‘কানাডিয়ান টায়ার’। আমাদের দেশের মতো লেখা নেই ‘আসগর আলী সুপার মাকের্ট’ কিংবা ‘নফিজা খাতুন ভ্যারাইটিজ স্টোর’। এ দেশে এত কিছু লেখার সময় নেই, পাবলিকেরও পড়ার সময় নেই। কার কী লাগবে, কোথায় পাওয়া যাবে এসব যার যার প্রয়োজনে খুঁজে বের করে নেয়। ‘নব হিল ফার্মস’ নামটি দেখে কী কারো বিভ্রান্তি হতে পারে না যে এটা কোনো মুরগি বা গরুর খামার! না, তা নয়। সকলেই জানে এটা একটা বড় গ্রোসারি দোকান। ‘জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভালো’। কানাডার জন্যই বোধহয় কবি লিখে গিয়েছেন, ‘কানাডার মতো দেশে নাম নয়, কর্ম দেখেই লোকে চেনে’।

এ দেশে নতুন এসে ঘুরতে খুব ভালো লাগে। বিভিন্ন জায়গায় দেখতাম বিনামূল্যের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকলেট। একবার একটা স্কুলের বুকলেটে দেখি লেখা ‘কুইট স্মোকিং’! এটা একটা কোর্সের নাম। ফি ৯৫ ডলার। ‘লার্ন ব্রিজ’! এটাও একটা কোর্সের নাম। ফি ৬৫ ডলার। আমার এক বন্ধু বললো, ব্রিজ শিখতেও এ দেশে স্কুলে যেতে হয়। আমার কাছে এলে তো আমি ফ্রি শিখিয়ে দিতাম। না, ফ্রি শেখালেও এ দেশে ছাত্র পাওয়া যায় না। সবাই অ্যাকাডেমিক পদ্ধতিকে শিখতে চায়। আর শেখার পর অ্যাকাডেমিক শিক্ষার বাইরে এক চুলও নড়বে না।

চুলের কথাই যখন উঠলো তখন একটা উদাহরণ দিই। একবার চুল কাটাতে গেলাম এক সেলুনে। দেখি নরসুন্দরী (নাপিতের মার্জিত স্ত্রী লিঙ্গ, অভিধানে নেই) পানির স্প্রে হাতে নিচ্ছে। আমি মাথায় পানি দেওয়া পছন্দ করি না। তাকে অনুরোধ করে বললাম, দয়া করে আমার মাথায় পানি লাগিও না। সে বললো, পানি ছাড়া সে চুল কাটবে না। তার বসকে বললাম, তোমার কর্মচারীটাকে বলো আমার মাথায় যেন পানি না দেয়। বস তাকে বললো, কাস্টমার যখন চাচ্ছে না তখন পানি দিও না। মেয়েটি বেঁকে বসলো। তার বসকে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো, স্কুল তাকে এভাবে শিক্ষা দেয়নি। মেয়েটির ব্যবহারে তাকে পাগল আখ্যায়িত করে সেদিন চেয়ার থেকে উঠে চলে এলাম।

উত্তর আমেরিকার অধিকাংশ ফাস্টফুড দোকানের নামের উৎপত্তি প্রতিষ্ঠাতার নামে। যেমন ‘ম্যাকডোনালস’, ‘হারভিজ’, ‘উইন্ডিজ’ ইত্যাদি। তবে কিছু কিছু অদ্ভুত নামও আছে, যেগুলো দেখে নতুন আগন্তুকদের বিভ্রান্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক যেমন একটি দোকানের নাম ‘সাবওয়ে’। এখানকার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনকেও সাবওয়ে বলা হয়। আরেকটি দোকানের নাম ‘সাবমেরিন’। না, এটা যুদ্ধজাহাজ নয়। এটাও একটা ফাস্টফুডের দোকান।

সেদিন পরিচিত একজনের কাছ থেকে এ বিষয়ক মজার একটা গল্প শুনলাম। টরন্টো থেকে জনৈক ব্যক্তি দেশে গিয়ে বিয়ে করেছেন। শ্বশুরপক্ষের লোকজনের কাছে তিনি পরিচয় দিয়েছেন যে, কানাডার সাবমেরিনে কাজ করেন। আর তাই শ্বশুরপক্ষের লোকজন নাকি কানাডার কাউকে পেলে তাদের জামাই বাবাজির খবর জিজ্ঞেস করেন এবং পরিচয় দেন যে তাদের জামাই সাবমেরিনে কাজ করেন। অবশেষে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে যে, জামাই বাবাজি ঠিকই সাবমেরিনে কাজ করেন। তবে ঐ যুদ্ধজাহাজ সাবমেরিনের কারখানার নয়। এ কারখানায় তিনি লার্জ, এক্সর্টা লার্জ সাবমেরিনের স্যান্ডউইচ তৈরি করেন।

কানাডাতে কিছু কিছু ব্যাপার দেখে বিস্মিত হলেও ভালো লাগার অনেক কিছু রয়েছে এবং ভালো লাগার বিষয়ই বেশি। তাই তো প্রতি বছর এ দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসে, মানুষ থেকে যায়, একসময় এ দেশের আবহাওয়ার সাথে, পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। তখন আর আজবকে আজব মনে হয় না। এ দেশে মানুষ আসে উন্নত জীবনের আশায়, উন্নত শিক্ষা লাভের আশায়। এখানকার পড়াশোনার বিশেষত্ব আছে। কানাডার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সার্টিফিকেটের মূল্য অনেক। যদিও এখানে এ সার্টিফিকেট দিয়ে উপযুক্ত কাজ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর, তবে পেয়ে গেলে উন্নত জীবনযাপনের আকাঙ্খা পূরণ করতে বেশি সময় লাগে না।

এক গবেষণায় জানা গেছে যে, কানাডাতে শতকরা একটি পরিবারের বাৎসরিক গড় আয় ২ লক্ষ ৯৫ হাজার ডলার। আর এ ধরনের পরিবারের সংখ্যা প্রায় ৭৩ হাজার ৬ শত। এর মধ্যে ৫ হাজার ১৫০টি পরিবারের বাৎসরিক আয় ৫ লক্ষ ডলারেরও বেশি। আয় শুমারির প্রতিনিধি আব্দুর রশীদ জানান যে, উচ্চ আয়ের অর্থ এই নয় যে তারা খুব ধনী। তরুণ দম্পতির আয় বেশি হলেও তাদের সম্পত্তি প্রবীণ দম্পতির চাইতে কম। গবেষনায় জানা গেছে, কানাডিয়ান প্রতি পরিবারের গড় বাৎসরিক আয় ৫১ হাজার ৩ শত ডলার।

Back to top button