সম্পাদকের পাতা

প্রতারনা : কানাডিয়ান ষ্টাইল

নজরুল মিন্টো

প্রতারনা আছে যুগে যুগে, দেশে দেশে। বাংলাদেশে আছে, আমেরিকায় আছে, কানাডাতেও আছে। আইনের দেশে থেকেও আইনকে ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা এদেশে হর হামেশা ঘটছে। কোথাও কোথাও এটা জায়েয বা লিগ্যাল হয়ে গেছেও বলা যায়। ফ্রড আর ট্রিকের ইংরেজী বানান ছাড়া আভিধানিক অর্থে তেমন কোন পার্থক্য যদিও নেই তবুও কানাডার লোকেরা সহজে ফ্রড শব্দটা ব্যবহার করে না। ট্রিকি হতে পারার মধ্যে কোথাও যেন বাহাদুরী আছে। গাড়ি কিনতে যান, বাড়ি কিনতে যান, বীমার পলিসি কিনুন অথবা আইনজীবীর কাছে যান সবখানেই একই অবস্থা। আপনাকে সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। বুঝতে হবে। ধীরে সুস্থে এগুতে হবে। তারপর পকেটে হাত দিন অথবা কলম বের করুন। আবেগে আপ্লুত হলেই কিন্তু গচ্চা!

প্রতারনা আছে যুগে যুগে, দেশে দেশে। বাংলাদেশে আছে, আমেরিকায় আছে, কানাডাতেও আছে। আইনের দেশে থেকেও আইনকে ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা এদেশে হর হামেশা ঘটছে। কোথাও কোথাও এটা জায়েয বা লিগ্যাল হয়ে গেছেও বলা যায়। ফ্রড আর ট্রিকের ইংরেজী বানান ছাড়া আভিধানিক অর্থে তেমন কোন পার্থক্য যদিও নেই তবুও কানাডার লোকেরা সহজে ফ্রড শব্দটা ব্যবহার করে না। ট্রিকি হতে পারার মধ্যে কোথাও যেন বাহাদুরী আছে। গাড়ি কিনতে যান, বাড়ি কিনতে যান, বীমার পলিসি কিনুন অথবা আইনজীবীর কাছে যান সবখানেই একই অবস্থা। আপনাকে সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। বুঝতে হবে। ধীরে সুস্থে এগুতে হবে। তারপর পকেটে হাত দিন অথবা কলম বের করুন। আবেগে আপ্লুত হলেই কিন্তু গচ্চা!

গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য এখানে নানা পন্থা অবলম্বন করা হয়। যেমন কোন কোন দোকানের সামনে লাগানো আছে ‘মেগা সেল, আপ টু ৯০%’ গিয়ে দেখা যাবে সব ক’টাতেই লাগানো আছে ১০% অফ। ফটো কপির দোকানে লেখা প্রতি কপি মাত্র ৩ সেন্ট। কাজ করিয়ে পয়সা দিতে গেলে দেখা যায় নিয়েছে ট্যাক্সহ ২২ সেন্ট। জিজ্ঞেস করলে হেসে হেসে বলবে এক হাজার কপির উর্ধ্বে ফটোকপি করলে তখন ৩ সেন্ট। এসব হচ্ছে ট্রিকস্।

কানাডার বিভিন্ন শহর থেকে চাকুরির তথ্য নিয়ে বহু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অর্ধ ডজন পত্রিকা আছে কেবল টরন্টোতেই। এ পত্রিকাগুলো কর্মখালির বিজ্ঞাপন দিয়ে সাজানো থাকে। প্রথম প্রথম ক্যানাডাতে এসে এসব পত্রিকা দেখে বন্ধু বান্ধবদের সাথে তর্ক জুড়ে দিতাম। কেউ যখন বলতো এদেশে চাকুরী নেই তখন বলতাম চাকুরির বিজ্ঞাপনের ওপর ভরসা করে এত পত্রিকা চলছে কি করে তাহলে? পরে জানলাম এখানে চাকুরী দেওয়ার জন্য প্রচুর এজেন্সী রয়েছে। আর এজেন্সীর বিজ্ঞাপনেই এসব পত্রিকার পাতা ভরে যায়। চাকুরির নামে ব্যবসা। আপনি ফরম ফিল-আপ করবেন, আপনার ইন্টারভিউ নেয়া হবে, আপনি ইন্টারভিউতে পাসও করবেন। তারপর আপনাকে বলা হবে ফাইল প্রসেসিং ফি দেয়ার জন্য। স্থানভেদে ২৫০ অথবা ৩০০ ডলার হতে পারে। এ কথা শুনে আপনি আশ্চর্য হতে পারেন! আবার লোকজনের ভিড় দেখে মনে হতে পারে সবাইতো আর আপনার মতো বেকুব নয়। আপনি ফি দেবেন। অতঃপর সত্যিকার অর্থে বেকুবদের খাতায় নাম লিখিয়ে ঘরে ফিরবেন।

যাই হোক, এসব পত্রিকায় চাকুরীর বিজ্ঞাপণের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বিভিন্ন সার্ভিসেস, মডেলিং এজেন্সী, বিভিন্ন বানিজ্যিক শিক্ষালয় এবং অর্থ ধার দেয়ার প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপণ। বিজ্ঞাপনদাতারা জানে এসব পত্রিকা কারা পড়ে তাই তাদের উদ্দেশ্য করেই তারা সুন্দর করে শব্দ সাজায়। যেমন, অর্থ ধার দেওয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন হচ্ছে ‘আপনার আর্থিক রেকর্ড ভালো মন্দ যাই থাকুক না কেন, কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই আমরা আপনাকে ধার দিতে পারি। কোন জামানত দিতে হবে না। নিশ্চয়তাকারী বা কোন জামিনদার লাগবে না। ২৪ ঘন্টা আমরা সার্ভিস দিয়ে থাকি। ফোন করুন….।’ আমার এক পরিচিত বাঙালি একবার অতি উৎসাহে এক কোম্পানীকে ফোন করে পাঁচ হাজার ডলার চাইলো। সাথে সাথে অ্যাপোয়েন্টম্যান্ট। যাওয়ার পর ঐ কোম্পানীর কর্মকর্তা একজন বললো, ‘কোন অসুবিধা নেই, সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে এসেছো। এই ফরমটা পূরণ করে ২৫০ ডলার ফী হিসেবে জমা দিলে এখনই তোমার ফাইল প্রসেসিং শুরু করে দিতে পারি। আমরা প্রথম দু’মাসের সুদ নিই না। অতএব তুমি অতিরিক্ত কোন টাকা দিচ্ছ বলে মনে করো না!’

আমার সেই পরিচিতজন খুশীতে গদগদ হয়ে তৎক্ষনাৎ ২৫০ ডলার দিয়ে ফরম পূরণ করে বাড়ি এসে দিল লম্বা ঘুম। পাঁচ হাজার ডলার দিয়ে কি কি করবে তার একটা লিষ্টও ঐ রাতে তৈরি করে ফেললো। একদিন যায়। দু’দিন যায়। ফোন করে। আজ পিটার নেই, কাল জেমস নেই, পরশু অ্যাপ্লিকেশন প্রসেসিং-এ আছে। …..অতঃপর দুই সপ্তাহ পরে জানা গেলো অনিবার্য কারনবশতঃ এ অ্যাপ্লিকেশন অনুমোদন হয়নি। সাথে সাথে ভদ্রলোক ছুটলো সে অফিসে। বললো আমার ২৫০ ডলার ফেরৎ দাও। কোম্পানীর কর্মকর্তা আশ্চর্য হয়ে বললো, এটাতো তুমি আমাদের প্রসেসিং ফী হিসেবে দিয়েছো। কাগজটা পড়োনি? এই যে তোমার দস্তখত! ফী-র টাকা ফেরৎ দেওয়ার নিয়ম কোম্পানীর পলিসিতে নেই।

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার মান নিয়ে প্রায়ই কথা উঠে। এ বিষয়ে অভিভাবকসহ দেশের জনগণ যে শংকিত এ কথা নতুন করে বলার দরকার নেই। শিক্ষাবিদরাও যে কত চিন্তিত সে কথার উল্লেখও না করলে চলে। ভূয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ভূয়া ডিগ্রীধারী, ভূয়া শিক্ষক শিরোনামে প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদ চোখে পড়ে। অতি সম্প্রতি ঢাকায় এমবিবিএস ডাক্তারি সার্টিফিকেট প্রদানকারী এক ভূয়া মেডিকেল কলেজের মালিককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে খবরে প্রকাশ।

এ ধরনের প্রতারণা কি কেবল বাংলাদেশ নাকি বিশ্বজুড়ে এ প্রশ্ন অনেকের। সহজ উত্তর হচ্ছে- কানাডা-আমেরিকা মোটেই এর ব্যতিক্রম নয়। মাত্র কয়েকশত ডলার খরচ করলে এখানে ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়ারও বহু প্রতিষ্ঠান আছে।

কানাডায় বহু ধরনের স্কুল কলেজ আছে যেগুলোকে সাইনবোর্ড সর্বস্ব বলা হয়ে থাকে। আগেও ছিল, এখনও আছে। স্কুল ব্যবসার সময় ছিল নব্বই দশক। ঐ সময়ে কানাডার বিভিন্ন শহরে-বন্দরে ব্যাঙের ছাতার মতো স্কুল গজাতে শুরু করে। বেশির ভাগই ল্যাংগুয়েজ, কম্পিউটার এবং ভকেশনাল শিক্ষার নামে। বাহারি নামের একেকটি স্কুল। কোথাও কোথাও লিখা হতো কলেজ। ‘কলেজ’ শব্দটি কানাডার স্বীকৃত কোন শিক্ষা স্তর নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এশীয়দের আকৃষ্ট করার জন্যই শব্দটি ব্যবহৃত হতো। বিদেশী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করার জন্য এইসব প্রতিষ্ঠান নানান ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলোভিত করে। এমনকি চাকুরীর নিশ্চয়তা, মোটা বেতনের কথাও ঐসব বিজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকে। বাস্তবে দেখা গেছে তাদের সবকিছু ভূয়া এবং এসব স্কুল থেকে যে সার্টিফিকেট দেয়া হয় তার কোন মূল্য কোথাও নেই। চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছিল এসব প্রতিষ্ঠান। অবশেষে তাদের প্রতারণা ধরা পড়ে এবং জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, বহু শিক্ষার্থী এভাবে প্রতারিত হয়ে অর্থ ও জীবনের অনেক মূল্যবান সময় অপচয় করেছেন।

১৯৮৯ সালে আমি নিজে এ ধরনের এক চক্করে পড়েছিলাম। ডাউন টাউনের একটি বিজনেস স্কুলের বিজ্ঞাপন আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো। পরদিনই গিয়ে কাউন্সিলর-এর সাথে আলাপ করলাম। বহু বিষয়ের মধ্যে সাউন্ড টেননিশিয়ান-এর উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখে এ বিষয়টি পছন্দ করি। স্কুল থেকে যে ব্রোশিওর ছাপা হয়েছে তাতে প্রতিটি কোর্সের সময় সীমা, ফী, চাকুরীর বাজার ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য দেয়া আছে। আমার পছন্দকৃত বিষয়টি ঐ বছরই তারা শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেলো। দেখলাম চাকুরির বাজারে এ পেশার ভাল চাহিদাও রয়েছে। সেদিনই প্রথম টার্মের ফী জমা দিয়ে ঘরে ফিরলাম। সে যে কত প্রস্তুতি, কত রকমের স্বপ্ন দেখা শুরু হলো!

ক্লাশ শুরুর নির্দিষ্ট দিন স্কুলে গিয়ে শুনি পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ এ কোর্স বাতিল করে দিয়েছে। কোন চিঠি নেই, কোন নোটিশ নেই এ কেমন কথা! আমাকে বলা হলো অন্য একটি বিষয় পছন্দ করতে। আমি তাদের এহেন ব্যবহারে এতই রুষ্ট হয়েছি যে ফ্রি শিখালেও সেখানে থাকতাম না। আমি আমার পয়সা ফেরত চাইলাম। রিফান্ড দেয়ার নিয়ম নেই বলে তারা নানান বাহানা শুরু করলো। ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে অনেক কষ্টে সে টাকার একাংশ আদায় করতে সক্ষম হই। সময় চলে যাওয়ায় অন্য কোথাও ভর্তি হওয়ার সুযোগ হারিয়ে ভীষণ মন খারাপ তখন। এমন সময় আমার বন্ধু এনামুল হক সারজাহ থেকে টরন্টো এলেন; যিনি পরবর্তীতে কোর্স বিশেষজ্ঞ হিসেবে বন্ধু মহলে পরিচিতি লাভ করেন। অতঃপর তার অনুপ্রেরণায় হাম্বার এবং পরবতী‍র্তে জর্জ হারভে-তে প্রিন্টিং টেকনোলজিতে ভর্তি হলাম। চার বছর ছিলাম একসাথে। একসাথে যেতাম, একসাথে ফিরতাম। বিভিন্ন দেশের অনেক বন্ধু জুটেছিল ঐ সময়। স্মৃতিতে এখনও উজ্বল সেই রঙিন দিনগুলি।

Back to top button