সম্পাদকের পাতা

বিয়ে : আমেরিকান ষ্টাইল

নজরুল মিন্টো

উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশ কমিউনিটি দিন দিন বড় হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে কমিউনিটির বিভিন্ন কর্মকান্ড সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে আজকাল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকান্ডের ব্যাপ্তি দেখলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। নিউইয়র্ক, টরন্টো, মনট্রিয়লসহ বিভিন্ন শহরে যেসব বাঙালি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন তাদের ছেলেমেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রজন্মের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখন সামনে। অনেক অভিভাবকরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আগে ছেলে বা মেয়ে উপযুক্ত হলে অভিভাবকরা দেশে নিয়ে যেতেন। প্রথম কারন ছিল এসব দেশে পাত্র-পাত্রির অভাব এবং দ্বিতীয় কারন ছিল দেশে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত নিজস্ব রীতি-নীতি অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা।

উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশ কমিউনিটি দিন দিন বড় হচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে কমিউনিটির বিভিন্ন কর্মকান্ড সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে আজকাল সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মকান্ডের ব্যাপ্তি দেখলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। নিউইয়র্ক, টরন্টো, মনট্রিয়লসহ বিভিন্ন শহরে যেসব বাঙালি দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন তাদের ছেলেমেয়েরা এখন বড় হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় প্রজন্মের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এখন সামনে। অনেক অভিভাবকরা এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। আগে ছেলে বা মেয়ে উপযুক্ত হলে অভিভাবকরা দেশে নিয়ে যেতেন। প্রথম কারন ছিল এসব দেশে পাত্র-পাত্রির অভাব এবং দ্বিতীয় কারন ছিল দেশে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন পরিবেষ্টিত নিজস্ব রীতি-নীতি অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা।

সময় বদলেছে। এসব দেশে এখন উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর অভাব নেই। অনেকের মতে, দেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে বরং অনেক ঝামেলা। প্রথমতঃ মানানসই পাত্র-পাত্রী পাওয়া মুশকিল। আর পাওয়া গেলেও মানসিক ভাবে মিল থাকবে কি, থাকবে না এটাও একটা চিন্তার বিষয়। উপরোন্ত পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশে গিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করার চাইতে এখানে সম্পন্ন হলে আর্থিক সাশ্রয়ও ঘটে। একটি পরিবারের জন্য আর্থিক দিকটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বরপক্ষ এবং কনে পক্ষের সাথে আলাপ আলোচনার প্রেক্ষিতে কথাগুলো বললাম। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, দেশে যেখানে বরপক্ষ এবং কনেপক্ষ আলাদা পার্টি দিয়ে থাকেন প্রবাসে কিন্তু দুই পক্ষ মিলে একটিই পার্টি দিয়ে থাকেন । এটা আমার কাছে একটা ভাল দিক বলে মনে হয়। পাত্র-পাত্রী উভয়েই পরিচিত হলে এবং দুই পক্ষ থেকে দুটো পার্টির আয়োজন করা হলে অনেক সময় দু’জায়গায় যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। এদিক দিয়ে যৌথ আয়োজনে একটি পার্টি সময়োপযোগি।

আমাদের দেশে সামাজিক ভাবে এক ধরনের প্রতিযোগিতা থাকে। যাকে বলা হয় লোক দেখানো। যা এখানে নেই। একেবারে নেই বললেও ভুল হবে। কেউ কেউ মনে করেন ‘ইজ্জতের ব্যাপার’। কষ্ট হলেও তারা এ ভাব দেখাতে পছন্দ করেন। অবশ্য এখানে এগুলো কেউ কেয়ার করে না।

বৃটেনের বাংলাদেশ কমিউনিটির বেশিরভাগ বিয়ে ওখানেই সম্পন্ন হয়। প্রায় প্রতিটি শহরে গড়ে উঠেছে শেরওয়ানী-পাগড়ির দোকান। বিয়ের কার্ড সহ আনুষাঙ্গিক যাবতীয় জিনিষপত্রের জন্যেও অন্য কোথাও তাদের যেতে হয় না। সব পাওয়া যায়। কাজী থেকে ব্যাঙ্কুয়েট হলের মালিক সব দেশী। আজকাল আমেরিকান বাংলাদেশীদেরও বাইরে যেতে হচ্ছে না। সবকিছু হাতের নাগালে।

এদিকে আমাদের দেশজ সংস্কৃতিতেও আধুনিক ছোঁয়া লেগেছে। বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলা যায়। কিছুদিন আগে একজন আমার কাছে প্রশ্ন রাখলেন-নিকট অতীতে দেখা গেছে আমাদের দেশে বিয়েতে এতো আয়োজন ছিল না। আজকাল গায়ে হলুদের যে জমকালো অনুষ্ঠান হয় তা দেখে অবাক হতে হয়। তাকে আমার ধারণার কথা বললাম। আমার মতে সব কিছুর মূলে অর্থ। অর্থাৎ টাকা। আগে বাঙালিদের হাতে টাকা-কড়ি তেমন ছিল না। বিয়ের অনুষ্ঠান বলতে বাড়ির পেছন থেকে কলাগাছ দুটো তুলে এনে ফটক তৈরি করা; ঘুড়ি ওড়াবার রঙিন কাগজ কেটে সুতা দিয়ে বাড়ির চতুপার্শ্বে লটকিয়ে দিলেই ডেকোরেশন কমপ্লিট। সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে বিছানা চাদর বিছিয়ে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করতে পারলেই ইজ্জত রক্ষা হতো। শহর থেকে মাইক এনে সারারাত লতা মুঙ্গেশকর আর নূরজাহানের গান বাজানোটা ছিল এক ধরনের বিলাসিতা। অবশ্য বিত্তশালীদের বিয়ে বরাবরই অন্যরকম। হাতি বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বর আসতেন। সাথে ব্যান্ড পার্টি বাদ্য বাজাতে বাজাতে চলতো। যেমনটা হিন্দি ছবিতে দেখা যায়। বাঙালির হাতে এখন নগদ টাকা এসেছে। রঙিন কাগজের বদলে স্থান করে নিয়েছে বৈদ্যুতিক ডেকোরেশন লাইট। বিয়ে আর বাড়িতে হয় না; হয় কমিউনিটি সেন্টারে। হাতি-ঘোড়ার বদলে এসেছে হেলিকপ্টার।

বর আসেন হেলিকপ্টার ভাড়া করে। আর বরযাত্রীরা আসেন কার এবং মাইক্রোবাসে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি, যুক্ত হয়েছে ইমিগ্রেশন। কেউ সখ করে বিয়ের অনুষ্ঠান ভিডিওতে ধারণ করেন, কেউ ইমিগ্রেশনের প্রয়োজনে। লন্ডন, আমেরিকা-ক্যানাডার দূতাবাস অনেক সময় বিয়ের প্রমাণ চায়। আর প্রমাণ হিসেবে ভিডিওর বিকল্প নেই। এখন প্রয়োজন হোক বা না হোক মোদ্দা কথা ভিডিও করা রেওয়াজ হয়ে গেছে। যেহেতু ভিডিও করা হবে সেহেতু সুন্দর ডেকোরেশন-এর আবশ্যকতা আছে। গাড়ির আবশ্যকতা আছে। এরমধ্যে বিদেশ বিভূইয়ে যেহেতু দেশীয় রাজনীতির বাতাস লেগেছে সেহেতু ঐসব বিয়েতে দুএকজন এমপি/মন্ত্রী থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বরং না থাকলেই অস্বাভাবিক হবে। এদিকে হিন্দি ছবি দেখে দেখে বাংলার পাত্র/পাত্রীকূল অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। আগে কনে লম্বা ঘোমটা টেনে অজানা আশঙ্কায় দুলতো। চোখ মেলে তাকাবার সাহস ছিল না। বাপের বাড়ি ছাড়ার সময় একটা কান্নার রোল ওঠতো । এখন কনের হাসি হাসি মুখ। দুষ্টুমি ভরা চোখ। ঐশ্বরিয়া, শিল্পা শেঠি ভাব!

মানুন আর নাই মানুন, আমাদের অনেক সমস্যা আছে। সামাজিক সমস্যা মনে হয় বেশি। দেখা যায় আমরা নতুন কোন বিষয় খুব কম সময়ে গ্রহণ করে ফেলি আবার পুরনো অনগ্রসর ধ্যান ধারণাও ছুঁড়ে ফেলতে পারি না। অনেকে বলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পারেননি আমরা কিভাবে পারবো। এটা কথার কথা বটে! যে বিষয়ে বলছিলাম- বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার দেয়ার রীতি সব সমাজেই আছে। আমরা যেসব উপহার দিয়ে থাকি তা কতটুকু কাজে লাগবে এ চিন্তা করে কিন্তু কখনও কিছু দিই না। বেশি ঘনিষ্ঠ হলে স্বর্ণের কিছু, নইলে বড় একটা বাক্স হলেই হলো। কাগজ দিয়ে মুড়ে চললাম বিয়ে খেতে। দেখা যায় একই আইটেম পাঁচজন নিয়ে এসেছেন। অথচ দশজন যদি দশটি ভিন্ন ধরনের এমন জিনিষ নিয়ে যেতে পারতেন যেগুলো নতুন সংসারের কাজে লাগতে পারতো! আমরা আবার জিজ্ঞেস করে কাউকে কিছু দিই না! জিজ্ঞেস করে কাউকে কিছু খাওয়াই না! আমাদের আত্মসম্মানবোধ এদিক দিয়ে সদা জাগ্রত!!! তাই কি?

যাই হোক, বিয়ে তো অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মাঝেও আছে। দেখা যাক তারা কি করে। বৃটিশ, পোলিশ, গ্রীক, ইতালীয়ান, আমেরিকান, কানাডিয়ান সহ বিশ্বের অনেক জাতি উপহার হিসেবে নগদ অর্থ প্রদান করে থাকে। তাদের কথা হলো ‘ঠিক আছে বাপু, তোমাদের ইচ্ছে মতো দরকারি জিনিষ তোমরা কিনে নিও’। তা পঞ্চাশ ডলার হোক অথবা একশ ডলার হোক। একটা এনভেলাপের ভিতর যার যার সাধ্য অনুযায়ী নগদ অর্থ তারা দিয়ে থাকে।

এছাড়া আরেকটা বিষয় কানাডাতে লক্ষ্য করেছি। বিয়ের অনুষ্ঠান করার আগে নতুন দম্পতি তাদের সংসারের চাহিদা অনুযায়ী একটি গিফট বুক তৈরি করে। তাতে হাড়ি পাতিলসহ কি কি জিনিষ লাগবে এবং এগুলোর মূল্য এবং কোথায় পাওয়া যায় তা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়।

বে, সিয়ার্স, ওয়ালমার্ট-এর মতো বড় বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরসমূহে পাত্র-পাত্রীর নামে এ ধরনের গিফট বুক খোলা হয়ে থাকে। আমন্ত্রিত অতিথিরা এসব দোকানের একটিতে গেলেই হলো। সেলস পারসন গিফট বুক খোলে বলবে নব দম্পতি কি কি জিনিষের লিষ্ট করে গেছে। শুধু তাই নয় ইতিমধ্যে অন্য কোন অতিথি কোন একটি আইটেম নিয়ে গেলে সেটাও তারা লিখে রাখে। যেমন আপনি হয়তো ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন যে একটি মাইক্রোওভেন দেবেন। দোকানে গিয়ে দেখলেন এটা অন্য একজন নিয়ে গেছেন। তখন আপনাকে লিষ্টের অন্য আইটেম-এর দিকে তাকাতে হবে। সেটা হতে পারে একটি ভ্যাকুম ক্লিনার অথবা একটি রাইস কুকার।

বিশ্বটা এখন আধুনিক। আর আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও মানসিকতাও আধুনিক করে তোলা অপরিহার্য নয় কি?

Back to top button